‘আলু হইছে গলার কাঁটা’

সারাদেশে এবার আলুর ফলন ভালো হলেও উৎপাদন খরচ উঠে না আসায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেক চাষির। লাখ লাখ টন আলু কৃষকের ঘর আর উঠানে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে।
হিমাগার স্বল্পতায় আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না অনেক কৃষক। বাজার পড়ে যাওয়ায় বিক্রিও করতে পারছেন না।
পাশাপাশি হিমাগারে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম, বাজার সিন্ডিকেট, রপ্তানির উদ্যোগহীনতা- এসব জটিলতার কথাও তারা বলছেন।
কৃষকদের ভাষ্য, সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার তৈরির উদ্যোগ না নিলে প্রতিবছরই তাদের এ অবস্থার শিকার হতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর সারা দেশে রেকর্ড পাঁচ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি।
আর বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) ধারণা, চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন হবে ১ কোটি টনের বেশি। অথচ সারা দেশে দেশে বর্তমানে চালু থাকা সাড়ে তিনশ হিমাগারে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টন আলু রাখা সম্ভব।
কৃষকদের ক্ষতির বিষয়টি মাথায় নিয়ে কৃষি বিভাগ স্থানীয়ভাবে বিকল্প পদ্ধতিতে কিছুদিন আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছে।
দেশের যে কয়টি জেলায় সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়, তার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ একটি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলছিলেন, “আমরা বলতেই পারি যে, একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু কিন্তু বাইরে রয়ে গেছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি, তারা যেন স্থানীয়ভাবে আলু সংরক্ষণ করেন।
“তারা আলু মাচায় বা বস্তায় রাখতে পারেন। এর মাধ্যমে পরে তাদের উৎপাদিত আলু আরও একটু ভালো দামে বিক্রি করার সুযোগ তৈরি হতে পারে।”
তবে তাতেও বিপদ দেখছেন বগুড়ার শিবগঞ্জের সাদুরিয়া গ্রামের আলু চাষি তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, “এবার আলু জমিতে পোকার আক্রমণ ছিল বেশি। মাচা করে রাখতে গেলেও কীটনাশক দিতে হবে। তাতে খরচ আরও বেড়ে যাবে। তারপরও তিন মাসের বেশি রাখা যাবে না। বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি।”
কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর জেলার আলু চাষিদের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে।
ঘরে-বাইরে আলু আর আলু
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়নের মিথলমা গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন ও ফাহিমা আক্তার দম্পতি এবার তাদের দেড়শ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছে। গড়ে প্রায় এক হাজার মণ আলু পেয়েছেন তারা।
চলতি সপ্তাহে এই দম্পতির গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, ঘর-বাইরে সর্বত্রই আলু আর আলু। যেখানে একটু জায়গা পেয়েছেন সেখানেই আলু খোলা বা বস্তায় ভরে রেখে দিয়েছেন। তাদের হিসাবে, এখনও ৫০০ মণ আলু অবিক্রিত রয়ে গেছে।
কৃষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “বীজ আলু কেনা হয়েছে ১৭৫ টাকা কেজি। পরে বীজ আলু লাগিয়ে প্রতি মণ আলু চাষে খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে ৭৫০ টাকার মত। এখন আমি বাজারে গিয়ে দাম পাচ্ছি মণে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রতি মণে আমাকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। তাহলে কি আমি লোকসানে আলু বিক্রি করব?”
সাজ্জাদ বলেন, “অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বাড়ির উঠোনে আলু জমা করে রেখেছি। যদি একটু দাম বাড়ে তাহলেই ছেড়ে দেব। আর যদি এর মধ্যে বৃষ্টি-বাদল শুরু হয় তাহলে সব শেষ।”
একই রকম পরিস্থিতির কথা বলছিলেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার ধামাহার গ্রামের আলু চাষি বাবু মিয়া।
তিনি জানান, তার ছয় বিঘা জমিতে ৪২০ মণ আলু হয়েছে। চাষে খরচ হয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা। যার বাজারদর এখন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।
কয়েক হিমাগার ঘুরেও তিনি আলু রাখতে পারেননি। ফড়িয়ারা হিমাগারের বুকিং স্লিপ কিনে নিয়েছে। প্রায় এক মাস আগে থেকে হিমাগারে আলুর বুকিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক, মহাস্থান এবং সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেও একই রকম পরিস্থিতির তথ্য মিলেছে।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চাষি আতিকুর রহমান মুরাদ তার উৎপাদিত আলুর কিছু অংশ স্থানীয় হিমাগারে রাখতে পেরেছেন। তবে বেশির ভাগই বাড়িতে রেখেছেন।
হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, “না পারি বাইরে রাখতে, না পারি কোল্ডস্টোরে রাখতে। গলার কাঁটা হইছে এই আলু। তারপরও কিছু আলু বাসায় রাখছি আর কিছু আলু কোল্ডস্টোরে রাখছি। তবে সব মিলিয়ে আমরা আলু চাষিরা ভালো নেই।”
একই ওয়ার্ডের বেনুঘাট এলাকার চাষি আতিকুর রহমান মুরাদ বলেন, তিনি ২৪ দোন (২৪ শতকে এক দোন) জমিতে প্রায় ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে আলু আবাদ করেছেন। কিন্তু অর্ধেক দামও পাচ্ছেন না।
একই রকম ক্ষতির কথা বললেন রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চিলমন এলাকার কৃষক মহিফুল ইসলাম, সেলিম মিয়া, হাসান মিয়া এবং বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর এলাকার চাষি হাফিজার রহমান।
হিমাগারের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা
মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরের অ্যালাইড কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করতে ট্রলারে করে আলু নিয়ে এসেছেন কৃষক আব্বাস মিয়া। তবে তিনি সেখানে আলু রাখতে পারেননি। কর্তৃপক্ষ তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
আব্বাস মিয়া বলেন, যারা কোল্ড স্টোরেজে কোটা (স্লিপ) কিনছেন, ভরে যাওয়াতে তারাও আলু ফেরত নিচ্ছেন। আর যারা কোটা রাখেননি, তারা আরও বিপদে পড়েছেন।
“এখন কোল্ড স্টোরেজে কোনো জায়গা নেই। এখন আমরা যারা কৃষক আছি তাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নাই।”
মুক্তারপুরের এই হিমাগারে আলু রাখতে এসে হতাশ হয়েছেন চাষি সবুজ ব্যাপারীও। তিনি বলেন, “আলু নিয়ে এখন আমরা এক হিমাগার থেকে আরেক হিমাগারে যাচ্ছি। সবাই বলছে, জায়গা নাই। এখন আমরা কই যাই? এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাইতে খরচ আরও বাড়তাছে। কী করুম জানি না। কর্তৃপক্ষ বলছে, হিমাগার ভরে গেছে। এখন যে আলু আসছে তা আমরা কোথায় রাখব?”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, মুন্সীগঞ্জে সচল ৫৮ হিমাগারের ধারণক্ষমতা পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৭৬০ টন। জেলায় এবার ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৭৩৮ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু তা সংরক্ষণে হিমাগারে জায়গা না হওয়ায় চাষিরা বিপাকে পড়েছেন।
‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’
মুন্সীগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, দেশে এ বছর প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ মেট্রিক টন। আলুর উৎপাদন বাড়লেও হিমাগারের সংখ্যা বা ধারণক্ষমতা বাড়েনি। ফলে আলু নিয়ে বিপদে পড়েছেন চাষিরা।
তবে কেউ কেউ বলছেন, বাইরের জেলা থেকেও আলু আসছে। এ কারণে স্থানীয়রা বঞ্চিত হচ্ছেন।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের আলু চাষি হুমায়ুন শেখের অভিযোগ, রংপুর, জয়পুরহাট, বরগুনাসহ বিভিন্ন জেলার আলু এই জেলা-উপজেলার হিমাগারগুলোতে মজুদ রাখা হচ্ছে। কিছু ‘অসাধু’ ব্যবসায়ী হিমাগারগুলোতে আগে থেকে চুক্তিতে ‘কোটা’ (স্লিপ) কিনে রেখেছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আলু কিনে তারা সেখানে মজুদ রাখছেন। এতে করে এই জেলার কৃষকরা তাদের জমির আলু হিমাগারে রাখতে ভোগান্তিতে পড়ছেন।
তবে স্থানীয়রাই আলু রাখতে পারছেন বলে দাবি করেছেন মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির সিদ্ধেশ্বরী হিমাগারে ব্যবস্থাপক ফখরুল হাসান।
তিনি বলেন, তার এখানে ১৩ হাজার টন আলু রাখার জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে নয় হাজার টন আলু মজুদ হয়েছে। দুই-এক দিনের মধ্যে তাদের হিমাগার পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। প্রতি বস্তা আলুর ভাড়া ধরা হয়েছে ৩০০ টাকা।
সব আলু হিমাগারে রাখা যাবে না- এটা মেনে নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের উপ- পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এবার আলুর আবাদ হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩০০ হেক্টর বেশি। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন। যা গতবারের চেয়ে কয়েক হাজার মেট্রিক টন বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদ্প্তরের বগুড়ার অতিরিক্ত পরিচালক মো. নাজমুল হক জানান, বগুড়ায় সাড়ে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬২৭ টন আলু উৎপাদন হলেও ৪২টি হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যাবস্থা আছে মাত্র তিন লাখ টনের। সেখানে ব্যাবসায়ীদের প্রাধান্য থাকলেও কৃষকদের সুযোগ কমে যাওয়া স্বাভাবিক।
বগুড়ার মহাস্থান আগমনী হিমাগারের ব্যবস্থাপক এ কে এম আব্দুল্লাহ জানান, তাদের হিমাগারে ১৫ দিন আগেই আলুর বুকিং দেওয়ার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলায় যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়, তার তুলনায় হিমাগারের সংখ্যা কম। তাই অনেক কৃষক হিমাগারে আলু রাখতে পারেন না।
বিকল্প সংরক্ষণের পরামর্শ
যারা হিমাগারে আলু রাখতে পারেনি তাদেরকে স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।
সস্তায় আলু বিক্রি না করে ঘরে আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়ে মুন্সীগঞ্জের জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সামির হোসেন সিয়াম বলেন, “একটি ঘরে ২৫ থেকে ৩০ টন আলু কৃষক সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন। এখানে আলু রাখলে কিন্তু কিছু সময় পরে তারা লাভবান হতে পারবেন। ঘরে আলু রাখলে আলু সহজে পচে না। আর আলুর যে ওজন কমে এটা খুবই কম হয়।”
বগুড়ার শিবগঞ্জের অনেক কৃষক বাড়িতে মাচা করে আলু রাখছেন। তবে তাদের ধারণা, এতে দুই মাসের বেশি রাখা কষ্টকর হবে। যদি বৃষ্টি বাড়ে, তাহলে ক্ষতি আরও বেশি।
রপ্তানির দাবি
হিমাগার বাড়ানোর পাশাপাশি আলু রপ্তানিতে জোর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
মুন্সীগঞ্জ জেলা ক্যাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর সরকার মন্টু বলেন, “আলুর বাজারে ধস নেমেছে। এখন যদি আমাদের দেশ থেকে আলু বাইরের দেশের রপ্তানি না করে। তাহলে আলু বিক্রি হবে না। দেশে এখন যে পরিমাণ আলু আছে তাতে ডিসেম্বরের আগে এই বাড়তি আলু আর বিক্রি হবে না। কৃষক বাঁচাতে হলে আলু রপ্তানির কোনো বিকল্প নেই।”
কৃষক সংগ্রাম পরিষদের রংপুর জেলার আহ্বায়ক পলাশ কান্তি নাগ বলেন, “বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও বাজারের যে পরিস্থিতি দেখেছি বর্তমানে সময়েও কিন্তু একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানে এত মানুষের প্রাণদানের মধ্যে দিয়ে আমরা কী পেলাম?”
স্থানীয় চাষিদের আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি তিনিও আলু রপ্তানির জন্য সরকারি উদ্যোগের ওপর জোর দিয়েছেন।
রংপুর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শাকিল আকতার বলেন, “যেহেতু এবার আলুর উৎপাদন চাহিদার থেকে বেশি, সেহেতু আমরা রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটা সংযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আলু যেন দেশের বাইরে রপ্তানি করা যায়। সেটাও একটা পরিকল্পনা চলছে।”
বগুড়া কৃষি অধিদ্প্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. নাজমুল হক বলছিলেন, বাইরে আলু রপ্তানি করতে পারলে ভালো হত। গত বছর জেলা থেকে মালেশিয়া, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, কাতার, সৌদি আরব ও শ্রীলংকায় ১৭ হাজার ১৩৮ টন আলু রপ্তানি হয়েছে।