মঙ্গলবার ২১ জানুয়ারি ২০২৫, মাঘ ৮ ১৪৩১, ২১ রজব ১৪৪৬

ফিচার

ট্রাম্প ২.০: রক্ষণশীলদের আশা, উদারবাদীদের ভয়

 প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ২১ জানুয়ারি ২০২৫

ট্রাম্প ২.০: রক্ষণশীলদের আশা, উদারবাদীদের ভয়

বিশ্বকে চমকে দিয়ে যে বছর প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প, সে বছরকে অনেকেই রাজনৈতিক ভূমিকম্পের বছর অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন।

এরপর সময় অনেক গড়িয়েছে। চার বছরের টালমাটাল মেয়াদ পার করে জো বাইডেনের কাছে ২০২০ এর নির্বাচনে হেরেছিলেন এই রিপাবলিকান। পড়তে হয়েছে ব্যাপক আইনি ঝুট ঝামেলার মুখে। তাতে দম হারাননি, আবার নির্বাচনে লড়েছেন এবং এবারও ডেমোক্র্যাট এক নারী প্রার্থীকে হারিয়ে বসছেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের তখতে।

অনেকের মতে, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার শপথ গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রকে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের মুহূর্তে দাঁড় করিয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার গণ্ডি পেরিয়ে নতুন এক যুগের সূচনাও করতে পারে।

ডানপন্থিদের আশা, ট্রাম্পের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্র পুরনো সামাজিক মূল্যবোধে ফিরবে; অগ্রাধিকার পাবে মার্কিন নাগরিকদের অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকা। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত অবস্থানে থাকা লাখ লাখ আমেরিকানের ভয় হচ্ছে- ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন মানেই নতুন অন্ধকার যুগ।

তাদের অনেকের দৃষ্টিতে, ট্রাম্প অনেক বেশি স্বার্থান্ধ, অন্তর্মুখী ও হিংস্র, যা প্রান্তিকদের অবস্থান আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে নাজুক করে তুলবে।

এটা ঠিক, ২০১৬ সালে প্রথমবার হোয়াইট হাউজের টিকেট জেতার তুলনায় এবার নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ট্রাম্প অনেক বেশি প্রস্তুত। অনুগতরা লাইন দিয়ে আছে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক এজেন্ডাগুলোকে এগিয়ে নিতে, যা তার সমর্থকদেরও উৎসাহিত করবে, বিরোধীদের করে তুলবে আরও অসন্তুষ্ট।

আগের তুলনায় পরিপক্ক ট্রাম্প এবার ক্ষমতায় বসে কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ দিতে পারেন, নির্বাচনি প্রচারজুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে তার অবস্থান সে সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত তো দিয়েই রেখেছে।

অবস্থান পুনরুদ্ধার

নিজের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারে যে শব্দটিকে ট্রাম্প আজীবনই দূরে রাখতে চান সেটি হচ্ছে ‘লুজার’। কোনোভাবেই নিজেকে পরাজিতদের কাতারে দেখতে চান না তিনি।

যে কারণে ২০২০ সালে নির্বাচনে হেরেও তিনি এক মিথ্যা ভাষ্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আসলে তিনিই জিতেছেন, তাকে হারানো হয়েছে।

তার এ ভাষ্য সমর্থকদের যে ব্যাপকভাবে উসকে দিয়েছিল সেটির প্রমাণ মেলে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেসে হামলার ঘটনায়। এ ঘটনা ট্রাম্পের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দেবে বলে অনেকে ধারণাও করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করে ট্রাম্প ঠিকই রিপাবলিকান পার্টিতে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছেন, মন জিতে নিয়েছেন অনেক দল নিরপেক্ষরও।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পেছনে ছিল বিশাল ভক্তকূল, অভিবাসন আর মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ তো ছিলই, সঙ্গে নিজের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোকেও সমর্থন জোটাতে কাজে লাগিয়েছেন ট্রাম্প।

মহামারীর মধ্যে তিনি যখন দায়িত্ব ছাড়ছিলেন সেসময় তার প্রতি সমর্থন অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল, অথচ সেই মহামারীর কারণেই পরে দেখা দেওয়া অর্থনৈতিক সংকট বিশেষত মূল্যস্ফীতি তার পুনরুত্থানে বড় ভূমিকা রাখল।

অর্থনৈতিক অসন্তোষ নিরসন

বাইডেনের আমলে বেকারত্ব কম ছিল, মজুরিও বেড়েছিল, কিন্তু তারপরও দেশের অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো নয় এমন ভাবনাই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।

অনেক আমেরিকানই ভাবতেন মহামারীপূর্ব সময়ের কথা- যখন জিনিসপত্রের দাম আর সুদের হার ছিল এখনকার তুলনায় কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই যে অর্থনীতি নিয়ে বিরক্ত একের পর এক জরিপে তা বেরিয়ে আসছিল। ট্রাম্প এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়েছেন, অর্থনীতির এই দুরবস্থা নিরসনের আশ্বাস দিয়ে ‘মেইক আমেরিকা ওয়েলদি এগেইন’ ব্যানার ঝুলিয়েছিলেন।

নির্বাচনে জেতার পর এখন অবশ্য ট্রাম্প স্বীকার করছেন যে জিনিসপত্রের দাম কমানো ‘আসলেই কঠিন’। এদিকে তিনি যেসময় দায়িত্ব নিচ্ছেন সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ইতিবাচক পথেই রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তিনি কোনো পদক্ষেপ না নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আগের তুলনায় ভালো হয়ে যেতে পারে এবং তাতে তার অবস্থান আরও শক্তিশালীই হবে।

কর ছাড় আর ঋণের বোঝা

ট্রাম্প আদতে অর্থনীতি নিয়ে রিপাবলিকানদের চিরাচরিত রীতিতেই হাঁটতে চাইছেন। বড় আকারে কর কর্তন, অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের বাঁধন আলগা করা এবং বিস্তৃত আকারে তেল উত্তোলন। ২০১৭ সালে তিনি যে কর কর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা মূলত ধনীদেরই বেশি সুবিধা দিয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। তার প্রশাসন এরই মধ্যে এই মেয়াদ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যদিও তা দেশটির ফেডারেল ঋণ আরও ৫ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ঋণ ৮ ট্রিলিয়ন ডলার বেড়েছিল, যা এখনও জটিলতা সৃষ্টি করে চলেছে। তবুও নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে ট্রাম্পের পছন্দের প্রার্থী স্কট বেসেন্ট বিলিয়নেয়ারদের কর বাড়ানোর বিরোধিতা করে চলেছেন, বলছেন এই বিলিয়নেয়াররাই ‘চাকরি সৃষ্টি করে’।

এদিকে রাজস্ব সংকটের সমাধানে ট্রাম্প বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এমন পদক্ষেপ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

ফেডারেল বাজেটের অর্ধেকের বেশি সামাজিক নিরাপত্তার মত বিভিন্ন কর্মসূচি খেয়ে ফেললেও ট্রাম্প তার মেয়াদে প্রতিরক্ষায় ব্যয় বাড়াবেন বলেও মনে হচ্ছে।

এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় কমাতে তার যে চেষ্টা সেটিও বিরাট প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে। এখন এমনকি তার মিত্র ইলন মাস্কও ট্রাম্প প্রস্তাবিত দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় কমানো আদতেই সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

পররাষ্ট্রনীতি

ট্রাম্প দিনশেষে কেমন পররাষ্ট্রনীতি নেবেন তা আগেভাগে ধারণা করা মুশকিল। প্রথম মেয়াদে তিনি কোনো যুদ্ধে জড়াননি ঠিকই, তবে নানান দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তার কথার লড়াই বিশ্বকে ঠিকই অস্থির রেখেছিল।

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মনে হয়েছিল যুদ্ধ বেঁধেই যাচ্ছে, সেই উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে পরে তার সখ্যও হয়েছে, যদিও কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেননি তিনি।

এবার ক্ষমতায় বসেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে তার। তার জয় ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেও অনেকটাই দমিয়ে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার দিক থেকেও বেশ ইতিবাচক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। দেখা যাক, বিশ্ব এ যুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি পায় কিনা!

তবে ক্ষমতায় বসার আগেই ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ভূমিকা রেখে সব পক্ষের কাছ থেকেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছেন। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইসরায়েলের চরম ভক্ত ট্রাম্প অবশ্য কতদিন সেখানে শান্তির পক্ষে থাকেন তাও দেখার বিষয়।

ট্রাম্প এরই মধ্যে গ্রিনল্যান্ড, পানাম খাল এমনকি কানাডাকেও যুক্তরাষ্ট্রভুক্ত করার কথা বলে ফেলেছেন। মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদলেরও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। প্রায় প্রতিটি প্রস্তাবই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এখন এগুলো কী তার কথার কথা, নাকি সত্যিই ‘উপনিবেশ বিস্তারের’ পথেই হাঁটছেন তা চটজলদি বলাটা সমীচিন হবে না।

তবে তার গ্রিনল্যান্ডের দিকে চোখ তাইওয়ান নিয়ে চীনের অনেককে উৎসাহিত করে তুলেছে।

ট্রাম্প বারবারই নেটো এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় মার্কিন ব্যয় নিয়ে বেশ সোচ্চার। জলবায়ু সংকটকেও তিনি বিশ্বের সামগ্রিক সংকট হিসেবে দেখেন না, দেখেন রাজনৈতিক প্রচার হিসেবে। তার প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল, তবে বাইডেন এসে আবার তাতে যুক্ত হন। এবারও ট্রাম্প আগের মতই এসব বিষয়ে কট্টর অবস্থান নেন কি না, সেদিকেও অনেকের দৃষ্টি থাকবে।

অভিবাসন আর সাংস্কৃতিক লড়াই

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থাকার পরও ট্রাম্প কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোসহ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপের পরিকল্পনা করছেন।

২০২৪ সালে সীমান্ত টপকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার হার খানিকটা কমলেও বাইডেনের পুরো মেয়াদে অনেক শহরই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অভিবাসী সামলাতে হিমশিম খেয়েছে।

ট্রাম্পের মেয়াদে যে লড়াইটা সবচেয়ে তীব্র হবে বলে অনেকেই মনে করছেন, তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক লড়াই। কট্টর রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট বৈচিত্র্য, সাম্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রক্ষণশীলদের চিরাচরিত মূল্যবোধগুলোকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন। তিনি ‘টাইটেল নাইন’ নামে পরিচিত নাগরিক অধিকার আইনে দেওয়া সুরক্ষাও প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, যা ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীদের বিপাকে ফেলতে পারে।

ট্রাম্প ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলায় জড়িত অনেককে ছেড়ে দেওয়ারও অঙ্গীকার করেছন। তিনি তার রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে প্রতিশোধমূলক আচরণ করতে পারেন বলেও শঙ্কা আছে।

তবে তার পছন্দের অ্যাটর্নি জেনারেল প্রার্থী পাম বন্ডি বলেছেন, বিচার বিভাগকে রাজনীতিকিকরণ করা হবে না। তাতেও অবশ্য বিরোধীদের অস্বস্তি যাচ্ছে না।

করপোরেটদের সঙ্গে সম্পর্ক, নতুন ‘অলিগার্কি’

ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুই করছেন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যাপক সমর্থন দিয়ে। ইলন মাস্ক, জেফ বেজোসের মত বড় বড় কোম্পানির নির্বাহীরা তার প্রশাসনের সঙ্গে খাতির বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিলিয়নেয়ারদের প্রভাব যদিও নতুন নয়। কিন্তু এরপরও প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার বিদায়ী ভাষণে নতুন ‘টেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের’ উত্থান ও প্রভাবশালী ধনিকগোষ্ঠীর বিকাশের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন।

ট্রাম্পের দাবি এবার তিনি ‘অভূতপূর্ব ও শক্তিশালী জনরায়’ নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন। যদিও পপুলার ভোটে বিরোধী প্রার্থীর সঙ্গে তার ব্যবধান খুব একটা বেশি দেখা যাচ্ছে না। শপথ নেওয়ার পর সোমবার তিনি যে উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন, তা থেকেই তার এ মেয়াদের অগ্রাধিকার তালিকা ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মঞ্চ কেমন হবে তার খানিকটা বোঝা যাবে।

বিশ্লেষকদের অনেকেই সিট বেল্ট বেঁধে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, বিশ্ব বোধহয় ফের রোলার কোস্টারে চড়তে যাচ্ছে।