শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, আশ্বিন ২৫ ১৪৩১, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

ব্রেকিং

ধর্মীয় কারণে অত্যাচার-নির্যাতন হলে বিচারের মুখোমুখি করা হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ডেঙ্গু: এ বছর ৪০ হাজার ছাড়াল ভর্তি রোগী, মৃত্যু ১৯৯ রোববারের মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ না করলে দুর্বার আন্দোলনের আহ্বান আতঙ্কে লেবানন প্রবাসীরা, ফিরতে চান দেশে জামিনের পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন সাবেক মন্ত্রী মান্নান মিয়ানমারের নৌ-বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশি জেলে নিহতের খবর সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হ্যান কাং ইউনূসের ‘রিসেট বাটন’ নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন প্রেস সচিব ৩৬৫ দিনই নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শেরপুরের বন্যা: কৃষি খাতেই ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা

ফিচার

সেলুন থেকে আন্দোলনে, তারপর লাশ হয়ে ফিরলেন শিহাব

 প্রকাশিত: ১৬:৪০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সেলুন থেকে আন্দোলনে, তারপর লাশ হয়ে ফিরলেন শিহাব

ফেনীর ওয়াকিল আহমেদ শিহাব। মায়ের কথায় চুল কাটতে গিয়েছিলেন সেলুনে। তারপর বন্ধুর ডাকে যোগ দিতে যান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। কিন্তু ফিরে এলেন লাশ হয়ে।

শিহাবের শহিদ হওয়ার খবর পেয়ে দেশে ফিরেছেন তার সৌদি প্রবাসী বাবা সিরাজুল ইসলাম। তিনি বাসসকে বলেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। এই হত্যার বিচার নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। আমি আমার পুত্র হত্যার বিচার চাই।”

ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের আফছার ভুঁঞা বাড়ির মোঃ সিরাজুল ইসলাম ও মাহফুজা আক্তার দম্পতির পুত্র ওয়াকিল আহমেদ শিহাব(২০)। দুই ভাইয়ের মধ্যে শিহাব বড়। গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এক দফা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হন তিনি।

শিহাবের ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম বাসসকে বলেন, ৪ আগস্ট দুপুর ১২ টার দিকে বাড়িতে এসে আম্মুর সাথে দেখা করে শিহাব। আম্মু তাকে চুল কাটতে টাকা দিয়ে সেলুনে যেতে বলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আম্মুর সাথে কথা বলে বিদায় নেয় ভাইয়া। সেটিই ছিল আম্মুর সাথে শেষ দেখা। আম্মুর সাথে কথা বলে এক বন্ধুর সাথে রাস্তার দিকে যায়। দুইজনে নাস্তা করে ভাইয়া সেলুনে যায়। এরপর ভাইয়ার কাছে আরেক বন্ধু ফোন করে জানতে চায় আন্দোলনে যাবে কিনা। বন্ধুর ফোন পেয়ে চুল না কাটিয়েই সেলুন থেকে বের হয়ে মহিপাল আন্দোলনে চলে যায়।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে সায়েম বলেন, আমি দুপুরের ভাত খাচ্ছিলাম। তখন আম্মু বললো শিহাব এত দেরি করছে কেন, ওর খোঁজ নে তো। ভাইয়াকে অনেকবার ফোন দিলেও ধরেনি। ভাইয়া যেখানে কাজ করে সেখানেও খোঁজ নিই, তারাও আমাদের কিছুই বলেনি। বিকালে সবাই এসব বিষয়ে যখন কথা বলছিলাম, তখন একজন জানায় ভাইয়া সদর হাসপাতালে আছে। প্রথমে আমরা ভেবেছি ভাইয়া কাউকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে তাই দেরি হচ্ছে। তখনি আমার এক আত্মীয় ফোনে জানায় ভাইয়ার গায়ে গুলি লেগেছে।

শিহাবের ছোট ভাই আরো বলেন, খবর শোনার সাথে সাথে আমি এবং আমার চাচ্চু মিলে হাসপাতালে যাই। পথে কোন গাড়ি ছিল না, অনেক ভোগান্তি হয়েছে যেতে। ভাইয়াকে যখন খুঁজছিলাম তখন জরুরি বিভাগের সামনে ৫-৬টি লাশ পড়ে থাকতে দেখি। প্রথম লাশটির মুখের কাপড় সরিয়ে দ্বিতীয়টির কাপড় সরাতেই  দেখি ভাইয়ার লাশ।

তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, লাশ বুঝে নেওয়ার পর সবাই বলাবলি করছিল, দেরি করলে লাশ গুম করে ফেলবে। তড়িঘড়ি করে একটা সিএনজি করে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। ভাইয়ার লাশ দেখে আম্মু অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফেরেনি সারাদিনেও।

পরে যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন কেবল নিজেকেই নিজে দোষারোপ করছিলেন। বলছিলেন, “কেন চুল কাটতে যেতে বললাম তাকে।’’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বন্ধুর ফোন পেয়ে শিহাব সেলুন থেকে আন্দোলনে যোগ দেয়। যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন ফোনে ডেকে আনা বন্ধুটি ফ্লাইওভারের উপরে চলে যায়। সে সময় শিহাব পাশের সার্কিট হাউজ রোডে ঢুকলে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন। তার মাথায়, পিঠে এবং পায়ে ৩ টি গুলি লাগে। সেখান থেকে স্থানীয়রা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পুত্রশোকে দিশেহারা শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ছেলে সবসময় আমার কাছাকাছি থাকত, সেদিনও আমার সাথে দেখা করে গেছে। কিন্তু কে জানত সেটিই ছিল শেষ দেখা। দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়েছিল সে, খুনিরা তাকে হত্যা করল। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।

শিহাব হত্যার বিচার চেয়েছেন তার এলাকাবাসীও। দক্ষিণ কাশিমপুর এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, শিহাব সবসময় ভালো কাজের সাথে যুক্ত থাকত। যে কারও প্রয়োজনে সবার আগে দৌড়ে যেত। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে গুলি করে তাকে হত্যা করেছে। আমরা এ হত্যাকা-ের বিচার চাই।

শহিদ শিহাব ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ২০২১ সালে জয়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তী সময়ে মহিপাল প্লাজায় মোবাইল মেকানিকের কাজ শিখছিলেন তিনি। পরিবারে দুই সন্তানের মধ্যে বড় শিহাব। তার ছোট ভাই ওয়ালিদ আহমেদ সায়েম তামিরুল উম্মাহ মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

জানা যায়, সবসময়ই মানুষের উপকারে কাজ করতেন শিহাব। রক্তদান কর্মসূচি, সামাজিক কার্যক্রম ও খেলাধুলার সাথে যুক্ত থাকতেন সবসময়। ইচ্ছে ছিল পরবর্তীতে বিদেশ চলে যাওয়ার। তাই মহিপাল প্লাজায় মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ শিখছিলেন শিহাব।

এদিকে শিহাবের নিহতের ঘটনায় গত ২০ আগস্ট রাতে শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বাদী হয়ে ১৫১ জনের নাম উল্লেখ ও আরও ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ও ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে যথাক্রমে প্রথম তিন আসামি করা হয়েছে।