মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, আশ্বিন ১ ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্রেকিং

সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ: ফখরুল আন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘন: তথ্য চায় জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দল হোটেলকর্মী সিয়াম হত্যা : কারাগারে আসাদুজ্জামান নূর ও মাহবুব আলী চার শর্তে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক ক্রেতারা পাশে দাঁড়িয়েছে, এখন ঘুরে দাঁড়ানোর পালা: শ্রম সচিব যাত্রী খরা: ঢাকা-কলকাতা রুটে নভোএয়ারের ফ্লাইট বন্ধ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ২২৮ জনের বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ আরেক হত্যাচেষ্টা থেকে রক্ষা পেলেন ট্রাম্প বৃষ্টি কমে বাড়বে তাপমাত্রা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে অংশীদারীত্ব জোরদার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতে পালানোর সময় সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত আটক যশোরে পানিবন্দি ২৮ গ্রাম, ভেসে গেছে ঘের-ফসল

ফিচার

আব্দুল আলীমের ৫০০ গানের অর্ধেকই নেই সংরক্ষণে

 আপডেট: ১২:৪১, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আব্দুল আলীমের ৫০০ গানের অর্ধেকই নেই সংরক্ষণে

'এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই', 'পরের জায়গা পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই’, অথবা ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’র মত মাটির সুর মেশানো কালোত্তীর্ণ গানগুলোর গায়ক আব্দুল আলীমের পাঁচ শতাধিক গানের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সংরক্ষণে নেই।

তবে তার আড়াইশ থেকে তিনশর মত গান লিপিবদ্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।

ভাটিয়ালি, আধ্যাত্মিক, মরমি ও মুর্শিদি গানের জন্য কিংবদন্তী এই গায়কের মৃত্যুর ৫০তম বার্ষিকীতে এসে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছে গ্লিটজের।


আব্দুল আলীমের বড় ছেলে শিল্পী জহির আলীম ও মেয়ে নূরজাহান আলীমের আফসোস, তাদের বাবার সংগীতসম্ভারের বহু গান এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের মহাফেজখানায় তার বহু গান অযত্নে পড়ে আছে। কূটনৈতিক জটিলতায় স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশকেও আলীমের সেসব গান ফেরানো যায়নি।

প্রায় এক বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে চিঠি চালাচালির পর গত বছর আবদুল আলীমের ১২টি গান হাতে পেয়েছে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাই কমিশন।

কিন্তু আব্দুল আলীমের গানের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কোনো পৃষ্ঠপোষকতা মেলে না বলেও আক্ষেপ রয়েছে তার সন্তানদের।

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই জন্ম হয় আব্দুল আলীমের। মৃত্যু ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়।

সাতচল্লিশে দেশভাগের পর আব্দুল আলীম মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে থাকেন। সেই গল্প শোনা গেল তার ছেলে অধ্যাপক ও গায়ক জহির আলীমের কাছে।

গ্লিটজকে তিনি বলেন, "আব্বার বড় ভাই ঢাকায় চাকরি করতেন। চাচা আব্বাকে ঢাকায় চলে আসতে বলেন। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন চাচার সঙ্গে ছিলেন আব্বা। তারপর জিন্দাবাহার দ্বিতীয় লেইনের একটি মেস বাড়িতে ওঠেন।

“সেই বাসায় আব্দুল লতিফ, আব্দুল হালিম চৌধুরীসহ অনেক শিল্পী থাকতেন। আব্বা তখনো কলকাতার সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে খুব একটা পরিচয় তৈরি করে উঠতে পারেননি। ঢাকা এসেই গানের চর্চা পুরোপুরি শুরু করেন।“

মরমি গায়ক আব্দুল আলীম রবীন্দ্র, নজরুল, ভাটিয়ালী, বাউল, মরমী, মারফতি, মুর্শিদী, জারি, সারি, ইসলামিক গানসহ সব ধরনের গানই গাইতেন। তবে বলা হয়, ভাটিয়ালি গানেই আব্দুল আলীম মিশেছেন বেশি।

‘সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি’, ‘নাইয়া রে, নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘হলুদিয়া পাখি’, 'দোল দোল দোলনি', ‘দুখিনীর পরানের বন্ধুরে’, 'প্রেমের মরা জলে ডোবে না'– এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের শিল্পী তিনি।

আব্দুল আলীমের গাওয়া গানগুলো কোথাও লিপিবদ্ধ করা আছে কী না জানতে চাইলে নূরজাহান গ্লিটজকে বলেন, "না, সব আমাদের লিপিবদ্ধ নেই। ৫০০ গানের মধ্যে আমরা ২৫০ থেকে ৩০০ গান লিপিবদ্ধ করেছি। ষাটের দশকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান করতেন। সেখানে প্রায় দেড়শ গান রয়েছে।

“সেখানে বিভিন্ন গানের রেকর্ড হয়েছিল উর্দুতে। সেসব গানও আমরা খুঁজে পাইনি। গানগুলো ফিরিয়ে আনতে আমরা সরকারের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু মাত্র ১২টা গান আমরা পেয়েছি।

“বাকি গানগুলো আনতে প্রসেসিং চলছিল, কিন্তু হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। যে গানগুলো তিনি রেডিওতে গেয়েছিলেন সেগুলো তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে রেকর্ড হওয়া গানগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হোক। উনাদের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। আমরা কোনো উত্তর পাচ্ছি না।"

আলীম চর্চা ‘হচ্ছে না’

আলীম চর্চায় কোনো ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই’ বলেও আক্ষেপ ঝরেছে আলীমকন্যার কণ্ঠে। তার অভিযোগ, আব্দুল আলীম স্মরণে রাষ্ট্র ‘উদাসীন’।

“তিনি বাংলাদেশের সম্পদ, শুধু আমাদের সাত ভাই বোনের সম্পদ না। উনাকে নিয়ে যে ধরনের চর্চা হওয়া উচিত সেটা হচ্ছে না। উনাকে যেভাবে মূল্যায়ন করা দরকার ছিল সেই মূল্যায়ন কখনো হয়নি। আগে অনেক অনুষ্ঠান হত, এখন সেটা হয় না। প্রজন্মগুলো কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম চলে আসছে।

“উনাকে নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। গান সংরক্ষণ, উনার নামে একটা সড়ক নির্মাণ হয়নি, মিলনায়তন নেই। এমন কিছুই নেই যেটি ধরে কয়েক প্রজন্মের কাছে আব্দুল আলীম নামটা পৌঁছাবে। আমরা চার পাঁচ বছর ধরে ভাই বোনেরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা যে সমস্ত কাজ হাতে নিয়েছি, সেটাও কোনো না কোনো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই যে দিবসগুলো যায়, কোনো কার্যক্রম থাকে না। বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টার দায়সারা অনুষ্ঠান হতেও দেখা গেছে। যেটা মানুষ জানেই না। এগুলো আমাদের কষ্ট দেয়।"

নূরজাহান জানান, তিনি তার বাবাকে নিয়ে 'রঙ্গিলা নায়ের মাঝি' শিরোনামের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। এছাড়া 'আব্দুল আলিম ফাউন্ডেশন' নামের একটি সংগঠন করা হয়েছে।

আব্দুল আলীমের গানের চর্চা টিকিয়ে রাখতে ২০১৪ সালের দিকে জেলায় জেলায় গিয়ে গানের অনুষ্ঠান করতেন গায়কের বড় ছেলে শিল্পী জহির আলীম। সেই অনুষ্ঠান আবার শুরু করার ইচ্ছার কথা জানালেন তিনি। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে কাজটি করা কঠিন, সে কথাও বললেন।

“আমরা একটা অনুষ্ঠান করতাম। যেটা বাংলাদেশে জেলাগুলো ঘুরে ঘুরে করা হত। প্রত্যেকটা জেলায় তিন চারদিনের জন্য যেতাম। সেখানে যারা আব্দুল আলীমের গান করতেন, তাদের একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে একটা গানের অনুষ্ঠান করতাম।

“এটার উদ্দেশ্য ছিল যে আমরা তো আর সারাজীবন বেঁচে থাকতে পারব না। আব্বার গানের চর্চা যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখা যায়, গানগুলো যেন মানুষ সুন্দর করে গাইতে পারে, পরিশুদ্ধ হয়। তখন আমরা একটি সিডিও বের করেছিলাম। আবার সেই প্রোগ্রামটা চালু করতে চাই। কিন্তু এটা তো একার পক্ষে সম্ভব না।"

তথ্যচিত্রের মুক্তি এ বছরই

গেল বছরের জুন মাসে 'রঙ্গিলা নায়ের মাঝি' শিরোনামের একটি তথ্যচিত্র প্রযোজনার ঘোষণা দেন নূরজাহান। সেই সিনেমার কাজ প্রায় শেষের দিকে, চলতি বছরই মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

কাজটি করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে নূরজাহান গ্লিটজকে বলেন, "অনেক প্রতিবন্ধকতা পেয়েছি। আব্দুল আলীমকে নিয়ে আমাদের কিছু ভিডিও দরকার, যেগুলো বিটিভিতে ছিল। কিন্তু তারা তাদের আর্কাইভ অনেক আগেই নষ্ট করে ফেলেছে। বাংলাদেশের ফিল্ম আর্কাইভে কিছু আছে। সেটার জন্য আবেদন করেছি আমরা। সেগুলো পেলে কিছুটা হেল্প হবে। সিনেমার এডিটিং চলছে, আমরা এ বছরই মুক্তির প্রস্তুতি নেব।"

তথ্যচিত্রের কাজের জন্য মে মাসের দিকে বাবার জন্মস্থান মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলেন নূরজাহান। সেখানে গিয়ে তার এক অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে জানালেন।

নূরজাহান বলেন, "সেখানে এক চাচা এখনো বেঁচে আছেন, চাচাতো ভাইবোনেরা আছেন। চলচ্চিত্রের জন্যই যাওয়া। ডকুমেন্টারির জন্য অনেক তথ্য পেয়েছি। তালিবপুরে বাবাকে নিয়ে সেখানকার মানুষদের যে কী পরিমাণ উৎসাহ এবং আবেগ আছে তা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি।"

"আমি তিনদিন সেখানে ছিলাম। যে জায়গাগুলোতে গেছি, আব্দুল আলীমের মেয়েকে দেখতে মানুষের ঢল নেমেছে। যে স্কুলে বাবা প্রাথমিক পড়াশোনা করেছেন, সেখানে শিক্ষকরা আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। একটা খেলাধুলার অনুষ্ঠান ছিল। আমি গেলাম, আমাকে অনেকক্ষণ কথা বলতে হয়েছে। তারা বাবার ‘পরের জায়গা পরের জমি’ ও 'এই যে দুনিয়া' গান দুটি শোনানোর অনুরোধ করেন। আমি গান শুনাই। সেখানে 'আব্দুল আলীম মেলা' বা আব্বার নামে 'সংস্কৃতি চর্চা' করার জন্য কেউ কেউ প্রস্তাব দেন। আসার আগে কথা দিয়ে এসেছি, সিনেমা শেষ করে সেখানে যাব এবং এই মেলার আয়োজন আমরা করব।"

দুই সন্তানের কাছে 'বাবার স্মৃতি'

বাবার কথা স্মরণ করে জহীর আলীম বলেন, "আব্বা ছিলেন সুরের জাদুকর। আবার তিনি খুব সাংসারিকও ছিলেন। সবসময় আমাদের খোঁজ খবর রাখতেন। ছোট থেকেই আমরা গানের আবহে বেড়ে উঠেছি। আয়োজন করে গান শেখানোর প্রয়োজন হয়নি। আমরা নিজেরাই বাড়িতে বাজনা নিয়ে গান শুরু করে দিতাম। উনি তো সংগীত কলেজের শিক্ষক ছিলেন, মাঝে মধ্যে উনার সঙ্গে যেতাম। ছাত্ররা উনাকে খুব পছন্দ করতেন।"

নূরাজাহান বলেন, "গান শুনে কখনও অবাক হয়ে আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কী অসাধারণ কণ্ঠ ছিল তার! উনার কথা ভাবতে কষ্ট পাই, আবার ভালোও লাগে।“

আলীমকন্যার আহ্বান, বাংলা লোকগানের এই শিল্পীকে নিয়ে সঠিক চর্চার আয়োজন গড়ে তোলা হোক।

“তাকে নিয়ে কাজ করার সময় এখনো আছে, বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখা হোক। নতুন শিল্পীরা গান গায়, কলকাতার সংগীত অনুষ্ঠানে উনার গান গাওয়া হয়। নামটাও পর্যন্ত দেওয়া হয় না। উনাকে সঠিক সম্মান দেওয়ার দায়িত্বটা নেওয়া উচিত।"

অসংখ্য চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল আলীম। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমা দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। এছাড়া ‘সুজন সখী’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ’, ‘কাঞ্চনমালা’, 'এতটুকু আশা', 'আপন দুলাল', 'নবাব সিরাজ-উ-দৌলা', 'সুতরাং', 'বেদের মেয়ে', 'সাগরভাসা', 'পালাবদল', 'ঢেউয়ের পর ঢেউ', 'ভানুমতি', 'লালন ফকির', 'কাগজের নৌকা', 'দয়াল মুর্শিদ', 'রূপবান', 'দস্যুরাণী', 'কাঠপুতুলী', 'সোঁয়ে নদীয়া জাগে পানি', 'জোয়ার এল' সিনেমাতেও আব্দুল আলীম গান গেয়েছেন।