সাত কলেজ: প্রধান উপদেষ্টার জরুরি বৈঠকের ফল জানতে অপেক্ষা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বের হওয়ার ঘোষণার পর নতুন সংকটের আশঙ্কা সামনে রেখে জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস; তবে তার বিষয়বস্তু জানতে দুই দিন অপেক্ষা করতে বলেছেন ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ।
মঙ্গলবার রাতে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের ডেকেছিলেন। সেখানে সাত কলেজের বিষয়ে ‘ফ্রুটফুল’ আলোচনা হয়েছে। তবে কী আলোচনা হয়েছে সেটা নিয়ে এখন আলোচনা করব না। দুই দিন পর এটা নিয়ে আমরা জানাব।”
এদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন বলে তার দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান এস এম এ ফায়েজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।
সংঘাত আর সংঘর্ষের রাত পেরিয়ে আট বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বের হয়ে ‘সম্মানজনক পৃথকীকরণের’ পথে হাঁটতে শিক্ষার্থীদের সেই ‘কাঙ্খিত’ সিদ্ধান্ত আসে সোমবার।
দাবি আদায়ে গত কয়েক মাসের আন্দোলন-অবরোধের নানা ঘটনা প্রবাহ পেরিয়ে রাজধানীর বৃহৎ এসব সরকারি কলেজ মুক্ত হয়েছে।
কলেজগুলো পরিচালনার সম্ভাব্য কাঠামো ও চলতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা সামনে এসেছে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত ‘প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়ন কমিটির’ প্রধান ইউজিসি চেয়ারম্যান ফায়েজের কথায়।
এমন প্রেক্ষাপটেই মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা জরুরি বৈঠক ডাকালেন।
২০১৭ সালে রাজধানীর এই সাত কলেজ হল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। কলেজগুলো হল-ঢাকা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ইডেন কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ।
গত ৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এ কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষা নিতে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের জন্য ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওইদিনই অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলার কথা।
ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১৮ এপ্রিল থেকে লিখিত ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে আগের শিক্ষাবর্ষে পরীক্ষা হয়েছিল মে মাসে। এখন নতুন সিদ্ধান্ত আসায় এ ভর্তি বিজ্ঞপ্তির কী হবে তা এখনও অজানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে মুক্ত করে ঢাকার সরকারি সাত কলেজকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে আনার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রোববার সন্ধ্যায় পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রোভিসি) মামুন আহমেদের সঙ্গে আলোচনা করতে যান। সেখানে তিনি ‘দুর্ব্যবহার’ করেন বলে পরে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা।
এর প্রতিবাদে রাতে শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব ও টেকিনিক্যাল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। পরে সায়েন্সল্যাব মোড়ের অবরোধ থেকে মিছিল নিয়ে উপউপাচার্য মামুন আহমেদের বাসভবন অভিমুখে রওনা হন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।
মিছিলটি নীলক্ষেত মোড় হয়ে ক্যাম্পাসের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে এলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেয় বলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ।
পুলিশের বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতের’ অভিযোগ তুলে তারা হামলায় জড়িত সবার বিচারের দাবিতে সোমবার সকাল ৯টা থেকে নিজ নিজ কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করার ঘোষণা দেন।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার দুপুরে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।
তিনি ঘোষণা দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সাত কলেজের ‘সম্মানজনক পৃথকীকরণের’ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে, অর্থাৎ চলতি বছর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে।
পরে সোমবার রাতে ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে এসে নতুন কর্মসূচি দেন মুঈনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘মুখোমুখি’ অবস্থানে দাঁড় করানোর দায় নিয়ে উপউপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদকে পদত্যাগ করতে হবে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাকিবের ওপর ‘হামলার’ ঘটনায় নিউ মার্কেট থানার দায়িত্বশীলদের প্রত্যাহার করতে হবে। একইসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে ‘ক্ষমা’ চাইতে হবে।
এসব দাবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পূরণ না হলে নিউ মার্কেট থানা ঘেরাও এবং সাত কলেজের সামনে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসসহ কোনো যানবাহন চলতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন মুঈনুল ইসলাম।
মঙ্গলবার দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর ওই কর্মসূচি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত জানিয়ে রোববার রাতের ঘটনার জন্য আবারও উপউপাচার্য মামুন আহমেদকে দায়ী করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা।
মুঈনুল বলেন, “সেদিনের হামলায় বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মানুষের ইনভল্বমেন্ট থাকতে পারে। এজন্য আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি মামুন আহমেদ স্যারকে দায়ী করব। তিনি যদি শুরুতে ক্ষমাটা চাইতেন, বা উদ্যোগ নিতেন, তাহলে এ ঘটনাটা ঘটত না।
“প্রোভিসির বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র একটা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছে, প্রোভিসি মামুন আহমেদ আর সম্পৃক্ত থাকবেন না। তার পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে ওই দিনের ঘটনায় সাত কলেজের যে ছাত্র প্রতিনিধিরা ছিলেন, তারা ভিসি স্যারের সঙ্গে বসবেন, সেখানে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।”
শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাকিবসহ অন্য শিক্ষার্থীদের ওপর যে ‘হামলা’ হয়েছে, এর তদন্ত করতে তিন দিন সময় নিয়েছে সরকার।
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন মৌ বলেন, “আমাদের ছয় দফা দাবির একটি মেনে নেওয়া হয়েছে। বাকি দাবিগুলো নিয়েও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা আশা করি পজেটিভ সিদ্ধান্ত আসবে।”
তিনি বলেন, “সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন, তোমরা বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছ। কোনো সেশন জট যাতে না হয়, সে বিষয়ে এখন কাজ করা হবে।”
২০১৪ সালের শেষ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশ দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরের বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত করার তাগিদ দেন।
এর ধারাবাহিতায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ এই সাত সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।
সেসময় সিদ্ধান্ত হয়, এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে সময় কলেজ ছিল দুই হাজার ১৫৪টি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখের বেশি।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজে তখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী এবং এক হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক ছিলেন।
ওই সময় দেশের অন্য সরকারি কলেজগুলোকেও ধারাবাহিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু সাত কলেজের পর সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি।
তবে দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ায় প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে ‘হয়রানি’, অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ না করা, সেশনজট, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল প্রকাশ, রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া– ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। আট বছরেও এসব সংকটের সমাধান হয়নি। উল্টো পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।