বাংলাদেশে জলবায়ু সংকটে ৩ কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা ব্যাহত: ইউনিসেফ
তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়াজনিত বিভিন্ন ঘটনার কারণে গেল বছর বাংলাদেশে তিন কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার চিত্র উঠে এসেছে ইউনিসেফ এর এক প্রতিবেদনে।
প্রথমবারের মত প্রকাশিত জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ এর প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে চরম আবহাওয়াজনিত বিভিন্ন ঘটনার কারণে দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
শুক্রবার প্রকাশিত “লার্নিং ইন্টারাপটেড: গ্লোবাল স্ন্যাপশট অব ক্লাইমেট-রিলেটেড স্কুল ডিসরাপশন ইন ২০২৪” শীর্ষক প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরার বিষয়টি বৈশ্বিক এ সংস্থার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
ইউনিসেফ এর ঢাকা কার্যালয় থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে গেল বছর তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যা ও খরার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে ৭৭টি দেশের অন্তত ২৪ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশও এ তালিকা থেকে বের হতে পারেনি।
বাংলাদেশে গেল এপ্রিল ও মে মাসে দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ শিশুদের পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) ও হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে সারা দেশে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুলে ছুটি দিতে বাধ্য হয়।
মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে বেশ কিছু জেলায় শিশুদের স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এরপর জুনে হয় তীব্র বন্যা, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আবারও শিশুদের শিক্ষার উপর।
বন্যায় সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্যে শিশুদের সংখ্যা ছিল ৭০ লাখ।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সিলেট জেলায়। তীব্র বন্যায় সেখানে ব্যাপকভাবে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে ছয় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
ইউনিসেফ, বাংলাদেশের হিসেবে গত বছর ১২ মাসের মধ্যে জলবায়ুজনিত কারণে সিলেট অঞ্চলে শিশুরা সব মিলিয়ে আট সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর খুলনা, চট্টগ্রাম ও রংপুর – প্রত্যেক জেলায় শিশুরা ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্কুল দিবস হারিয়েছে।
“চরম আবহাওয়াজতি ঘটনাবলীর তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা বার বার আঘাত হানার প্রবণতাও বেড়েছে। জলবায়ু সংকট এটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এগুলোর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষার ওপর এবং শিশুরা তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে,” বলেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স।
তিনি বলেন, “চরম তাপমাত্রা ও অন্যান্য জলবায়ুজনিত সংকট শুধু শিশুদের স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমই ব্যাহত করে না, বরং এর কারণে শিশুদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
“বড় সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকলে শিশুদের- বিশেষ করে কন্যাশিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সুযোগ বেড়ে যায়, বেড়ে যায় পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারনে শিশুবিবাহের ঝুঁকির হার। ”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষার জন্য স্কুল ও শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও পরিকল্পনার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে এবং শিক্ষায় জলবায়ু-কেন্দ্রিক বিনিয়োগ লক্ষণীয়ভাবে কম।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু খাতে অর্থদানকারী প্রতিষ্ঠান ও দাতা গোষ্ঠী, বেসরকারি খাত ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নীতি ও পরিকল্পনায় শিশুদের প্রয়োজনীয়তাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।
সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষা খাতকে জলবায়ু সহনশীল করে তুলতে অর্থায়ন ত্বরান্বিত করা, যাতে জলবায়ুর অভিঘাত সামলে নিতে সক্ষম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পরীক্ষিত, টেকসই ও কার্যকরী বিনিয়োগ করা যায়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে হবে সব শিশুর জন্য নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
ইউনিসেফের পরামর্শ হল- জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনাসমূহ নিশ্চিত করা- যার মধ্যে রয়েছে ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন ৩.০ এবং ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা)’- শিশুকেন্দ্রিক জরুরি সামাজিক সেবাসমূহ জোরদার করা। যেমন শিক্ষা, আরও বেশি জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ও দুর্যোগ-সহনশীল হয়ে গড়ে ওঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করা।
এছাড়া জলবায়ুকেন্দ্রিক নীতি-প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সকল পর্যায়ে শিশু ও তরুণদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার কথাও বলেছে ইউনিসেফ।
রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “বাংলাদেশে শিশুরা পরস্পর সম্পর্কিত দুটি সংকটের সম্মুখভাবে রয়েছে। এ সংকট হল- জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান শিখন দারিদ্র্য। এর ফলে তাদের টিকে থাকা ও ভবিষ্যৎ দুটোই হুমকির মুখে পড়ছে।
“যেহেতু শিশুরা কথা বলছে এবং জলবায়ু সংকটের বিপর্যয়কর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে, তাই নীতি-নির্ধারকদের অবশ্যই তাদের আহ্বানে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের প্রয়োজনগুলোকে জলবায়ু সংক্রান্ত নীতি ও অর্থায়ন পরিকল্পনাসমূহের কেন্দ্রে রাখতে হবে।”