দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জটিলতা নিরসন তিনদিনের মধ্যে: জবি উপাচার্য
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়া আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে ‘চূড়ান্ত হবে’ বলে আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক মো: রেজাউল করিম।
তিনি বলেছেন, আগামী সপ্তাহে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় গিয়ে জায়গা পরিদর্শন করে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজ নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেবে; তবে আশ্বাস মিললেও কাম্পাসে শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সচিবালয়ে মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বুধবার সকালে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন উপাচার্য রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, “সচিবালয়ে আজকে আমাদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হবে। তারা (সেনাবাহিনী) কাজটি নিতে সম্মতি প্রকাশ করেছে। আগামী রোববার সেনাবাহিনী দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পরিদর্শনে যাবে। তারা ভিজিট করে কোন কাজ কী পর্যায়ে আসে তা দেখে তারা সবকিছু তত্ত্বাবধানে নিবে।"
দাবি আদায়ে অনড় জবি শিক্ষার্থীরা
“ক্যাম্পাসের কাজের অগ্রগতির ব্যাপারে মিটিংয়ে একটা কমিটিও করা হয়েছে। এই কমিটি আগামী 'তিন কার্যদিবস' এর মধ্যে নির্মাণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে দিবে ।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সেনবাহিনীর সদস্যরা এই কমিটিতে আছেন বলেও জানিয়েছেন অধ্যাপক রেজাউল করিম।
শিক্ষার্থীদের অস্থায়ী আবাসন নিয়ে উপাচার্য বলেছেন, পুরান ঢাকার বাণী ভবন ও ড. হাবিবুর রহমান হলের স্টিল বেইজড ভবনের কাজ দ্রুত শেষ করার বিষয়ে সেনাবাহিনী মৌখিকভাবে সম্মতি জানিয়েছে।
সচিবালয়ের ওই বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উপাচার্য ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন ক্যাম্পাসের প্রকল্প পরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্পটির সহকারী পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
ক্যাম্পাস শাটডাউন রাখার ঘোষণা
উপাচার্যের আশ্বাস মিললেও তিন কার্যদিবসের মধ্যে সেনাবাহিনী কাজ না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্ববদ্যালয়ের চলমান শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রায়হান হাসান রাব্বি।
তিনি বলেন, “যতদিন পর্যন্ত দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ লিখিতভাবে সেনাবাহিনী নিচ্ছে না; ততদিন পর্যন্ত চলমান শাটডাউন অব্যাহত থাকবে।“
শিক্ষার্থীদের শাটডাউন নিয়ে উপাচার্য বলেন, “শিক্ষার্থীদের বলব চলমান আন্দোলনের শাটডাউন তুলে নেওয়ার জন্য। তাহলে ক্যাম্পাসের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।“
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তর ছাড়া আরো দুই দাবি হল পুরান ঢাকার বাণী ভবন ও ড. হাবিবুর রহমান হলের স্টিল বেইজড ভবনের কাজ দ্রুত শুরু ও শেষ করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আবাসনের ব্যবস্থা না হয়, ততদিন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।
এই দাবি নিয়ে গত রোববার সকাল সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনশন শুরু করেন তিন শিক্ষার্থী, যে কর্মসূচিতে দুপুরের দিকে আন্দোলনকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫-৪০ জনে।
বিকালে শিক্ষক সমিতির অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে তা প্রত্যাখান করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘একাত্মতা’ পোষণ করে অনশনে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম। তার সঙ্গে যোগ দেন প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকসহ কয়েকজন শিক্ষক।
আধা ঘণ্টার মত অবস্থান করার পর তারা অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন, এরপর উপাচার্যসহ শিক্ষকরা চলে যান।
পরে রাতে আন্দোলনকারীদের ১৪ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন, যাদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে দেখতে যান উপাচার্য রেজাউল করিম। তখন তিনি অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে ফের তা নাকচ করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর গভীররাতে সংহতি জানাতে অনশনস্থলে আসেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের অর্ধশতাধিক ছাত্রী। এরপর সকালে শিক্ষার্থীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে নামেন।
এরপর ক্যাম্পাসে অনশনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে সোমবার বিকালে সচিবালয় ঘেরাও করে অনশন ও বিক্ষোভ শুরু করে।
পরে সন্ধ্যা ৭টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষার্থীদের সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে চিঠি সংশোধনের আশ্বাস দেওয়া হয়। পরে তারা অনশন প্রত্যাহার করে নেন কিন্ত শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।
অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।
পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত অগাস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়াসহ তিন দাবিতে আন্দোলনে নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত ৫ নভেম্বর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন।
এরপর ১১ নভেম্বর ইউজিসি প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পে জগন্নাথের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিসহ ৫ দাবিতে সচিবালয় ‘ঘোরাও করেন’ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সেদিন শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তারা সচিবালয়ের বাইরে অবস্থান নেন। এরপর তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের তিন দিন সময় চাইলে সচিবালয়ের সামনের অবস্থান থেকে সরে যান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে পরদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণ কাজ সেনাবাহিনীকে হস্তান্তরে সায় দেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
এরপর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় এবারে অনশন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।