কারাদণ্ডিত ইমাম কী অপরাধ তাঁর?
সুস্থ-সুন্দর সমাজের জন্য ঈমান ও আমলে সালেহের যেমন বিকল্প নেই তেমনি একে-অপরকে ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য্য ও সহনশীলতার প্রতি উৎসাহিত করারও কোনো বিকল্প নেই। কুরআন মাজীদে সূরাতুল আসর-এ খুবই তাকীদের সাথে এ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। মানুষকে যদি ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে বাঁচতে হয় তাহলে অবশ্যই তাকে ঈমান ও আমলে সালেহ অবলম্বন করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘আমলে সালেহ’ শব্দের সাথে যেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ের কর্তব্য-পালন রয়েছে তেমনি আছে সামাজিক ও সামষ্টিক জীবনের দায়-দায়িত্ব পালনও। ইসলামের বিধানে বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধকে যেমন সমাজ-পরিচালকদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য সাব্যস্ত করা হয়েছে তেমনি প্রত্যেক মুমিনকে স্ব স্ব গণ্ডিতে সামর্থ্য অনুসারে এ দায়িত্ব পালনের আদেশ দেয়া হয়েছে।
কুরআন-সুন্নাহ্য় বিভিন্নভাবে এ কাজের গুরুত্ব, তাৎপর্য, সুফল ও মহত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। একে বলা হয়েছে, নাসীহা ও কল্যাণকামিতা এবং নুসরত ও সহযোগিতা। চিন্তাশীল মানুষের কাছে বিষয়টির যথার্থতা অস্পষ্ট নয়। মানুষকে সঠিক কর্ম ও বিশ্বাসের পথে পরিচালনাই তো তার প্রকৃত কল্যাণকামিতা। তেমনিভাবে মানুষকে অন্যায়-অনাচার থেকে নিবৃত্ত হতে সহযোগিতাই তো প্রকৃত সহযোগিতা। কারণ, দিন শেষে মানুষের কর্ম ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই তো তার সাফল্য নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে তার বিপথগামিতাই তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারকে ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা সাব্যস্ত করা হয়েছে। ঈমানের দুর্বলতম স্তর বলা হয়েছে ঐ ব্যক্তির অবস্থাকে, যে হাত দ্বারাও অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারে না, মুখ দ্বারাও না, তবে অন্তর থেকে অন্যায়কে ঘৃণা করে ও অন্যায় বিদূরিত হওয়ার প্রত্যাশা করে।
সারকথা এই যে, ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ ইসলামে এত গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রত্যেক মুমিনের প্রতি স্ব স্ব গণ্ডিতে তা পালনের নির্দেশনা আছে। মুসলমানদের স্বর্ণযুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ঐ সময়ের মুসলমানদের সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল কুরআন-সুন্নাহর প্রতি অবিচল আস্থা, শর্তহীন আনুগত্য ও কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা-বিস্তারের অদম্য প্রেরণা। ইসলামের বিধানে যা ভালো, তাকেই তারা সর্বান্তকরণে ভালো বলে বিশ্বাস করতেন। আর ইসলামের বিধানে যা মন্দ, তাকে তাঁরা অন্তর থেকে মন্দ মনে করতেন। ভালো-মন্দের এই মাপকাঠি তাঁদের কাছে পরিষ্কার ছিল। এ মাপকাঠিতেই তাঁরা নিজেদের কর্ম ও জীবনকে পরিমাপ করতেন এবং তারই নিরিখে উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করতেন। সে সময়ের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর চিন্তাধারা ও জীবনধারা তাঁদেরকে প্রলুব্ধ ও প্রভাবিত করতে পারেনি; বরং তাঁরাই ঐসকল জাতি-গোষ্ঠীর জীবনধারায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মানবজাতির মধ্যে এই মহা মর্যাদাপূর্ণ ও কল্যাণপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল ইসলামের মাধ্যমে, যা আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমগ্র মানবজাতির জন্য নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরণ করলেও তাঁকে নির্বাচন করেছেন আরবদের মধ্য থেকে। তাঁর প্রতি ঈমান এনে ও তাঁর পয়গাম ধারণ করে পৃথিবীর দিকে দিকে কল্যাণপূর্ণ পরিবর্তনের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন আরবরাই। আর এভাবেই বিশ্বের দরবারে অনালোচিত আরব জাতি ইতিহাসের পাদপ্রদীপেই শুধু উঠে আসেনি, মানবজাতির ইতিহাসে তারা সৃষ্টি করেছে এক আলোকজ্জ্বল অধ্যায়।
কিন্তু এই আদর্শিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে বিশেষত একশ্রেণীর আরব শাসক ও ধনকুবেরদের মধ্যেও ভয়াবহ রকমের অবহেলার বিস্তার ঘটেছে; বরং বলা যায়, বর্তমান সময়ের বিরাটসংখ্যক আরব, বিশেষত আরব রাষ্ট্রগুলোর কর্ণধারেরা অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের কারণে কোনো কোনো সাধারণ মুসলিম দেশ থেকেও পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। একটি বিশেষ আরব দেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত মুসলিম জাহানের কোটি কোটি মুসলিমকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় অতি সম্প্রতি মসজিদে হারামের একজন সম্মানিত ইমামের দশ বছরের কারাদণ্ডের সংবাদ মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। বলা হচ্ছে, তাঁর রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়ার কারণ একটি খুতবা, যাতে তিনি পশ্চিমা-সংস্কৃতির বিস্তার রোধের আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষত যুব সমাজকে নাচ-গান ইত্যাদির আসর বর্জন করে কুরআন কারীমের সাথে সম্পর্ক করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। খাদিমুল হারামাইন কি বলবেন- কী অপরাধ এই আহ্বানে? মসজিদের মিম্বার থেকে তো এই কল্যাণকামিতার ধ্বনিই উত্থিত হতে হবে। এই আহ্বানকে গণ্য করতে হবে কল্যাণকামিতার আহ্বান হিসেবেই। যে জাতি কল্যাণের আহ্বানকে কল্যাণকামিতা বলে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, দিন শেষে সে জাতিই মুক্তি ও সাফল্য অর্জন করে। মুসলিম জাহানের সর্বস্তরে এই বোধের বিস্তার সময়ের দাবি।
মসজিদে হারামের সেই মজলুম ইমামের প্রতি সালাম। আল্লাহ তাআলা তাঁকে দুনিয়া-আখিরাতে উত্তম বিনিময় দান করুন। জালিমের জুলুম থেকে হেফাযত করুন- আমীন।