বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এডিটর`স চয়েস

রমজান, অনুর্বর মুমিন হৃদয়ে নেমে আসুক তাকওয়ার এক পশলা বৃষ্টি -১ম

 প্রকাশিত: ১১:২১, ১৬ মার্চ ২০২২

রমজান, অনুর্বর মুমিন হৃদয়ে নেমে আসুক তাকওয়ার এক পশলা বৃষ্টি -১ম

মাহে রমযানুল মুবারক। শ্রেষ্ঠত্ব মহিমা ও অফুরন্ত ফযীলতে উদ্ভাসিত একটি মাস। মুমিনের বহুল প্রতীক্ষিত এই পবিত্র রমযানুল মুবারক আগমন করে রহমত বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে। বার্তা দিয়ে যায় সৌহার্দ সম্প্রীতি ও ভালবাসার। গোটা রমযানজুড়ে বয়ে যায় মুমিন জীবনে ঈমানী বসন্তের অবারিত সমীরণ। এ মাসকে ঘিরে সে সঞ্চয় করে গোটা বছরের ঈমানী আমলী ও রূহানী পাথেয়। অর্জন করে তাকওয়া ও খোদাভীরুতার বৈশিষ্ট্য। ধন্য হয় মহান রবের নৈকট্য ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে। কিন্তু কীভাবে? আজ আমরা সে বিষয়েই কিছু মুযাকারা করার প্রয়াস চালাব- ইনশাআল্লাহ।

রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। খায়ের ও বরকতের মাস। তাকওয়া অর্জন ও আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস। নেকী হাছিলের মাস। গুনাহ বর্জন এবং ক্ষমা লাভের মাস। প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার এবং সংযম সাধনার মাস। ভ্রাতৃত্ব চর্চার মাস। দয়া ও সহানুভূতির মাস। দেহমন শুদ্ধ ও পবিত্র করার মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ পাকের রহমত ও করুণা বান্দার প্রতি অধিক নিবিষ্ট হয়, নেক ও কল্যাণের দিকে ধাবিত হওয়া সহজ হয়। জাহান্নামের কপাটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এ মাসে। গুনাহের তাড়না দমিত হয়। শয়তান এ মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে। এ মাসে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্ত করে থাকেন জাহান্নামের আগুন থেকে।

অতএব এ মাস আল্লাহমুখী হওয়া, তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়া, তাকওয়া হাছিল করা এবং গুনাহ থেকে পাক-ছাফ হয়ে তাঁর নৈকট্য অর্জনের মোক্ষম সময়। কীভাবে বেশি থেকে বেশি আমলের মাধ্যমে নিজের ঈমানী যিন্দেগী দ্যুতিময় করে তোলা যায় এ মাস হল সেই চর্চা ও প্রচেষ্টার উপযুক্ত মুহূর্ত। আর তাই তো রমযানের চাঁদ উঠতেই ঘোষণা হতে থাকে-

يَا بَاغِيَ الخَيْرِ أَقْبِلْ، وَيَا بَاغِيَ الشّرِّ أَقْصِرْ.

ওহে কল্যাণ অন্বেষী, তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর, নেকীর পথে তুমি আরো বেগবান হও। ওহে অকল্যাণের যাত্রী, তুমি  নিবৃত্ত হও, নিয়ন্ত্রিত হও। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৮২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৭৯৫, ২৩৪৯১

মাহে রমযানে যেকোনো ধরনের নেক ও কল্যাণের প্রতি ধাবিত হওয়ার রয়েছে বিশেষ ফযীলত। তবে আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে বিশেষ কিছু আমলের কথা উল্লেখ করব, যা এ মাসের কারণে অধিক তাৎপর্য ধারণ করে।

এক. গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখা

ইসলামের মৌলিক পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে রমযান মাসে রোযা রাখা। রোযা রাখা এ মাসের মূল আমল। আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর রমযানে মাসব্যাপী রোযা রাখা ফরয করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

তো দেখা যাচ্ছে, রোযার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাকওয়া হাছিল করা। তাই আমার রোযা যেন আমার তাকওয়া হাছিলের উপলক্ষ হয়- এজন্য খুব গুরুত্বের সাথে রোযা রাখতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِه.

যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইহতিসাব তথা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং সওয়াবের প্রত্যাশা রেখে রমযান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮

তো ঈমান ও ইহতিসাবের উপলব্ধি জাগ্রত রেখে রোযা রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল এবং বান্দার গুনাহ মাফের একটা বড় মাধ্যম।

আল্লাহ তাআলার নিকট বান্দার রোযা অত্যন্ত প্রিয়। রোযা ও রোযাদারের ব্যাপারে হাদীসে কুদসীতে চমৎকার বিবরণ এসেছে-

قَالَ اللهُ: كُلّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ، إِلّا الصِّيَامَ، فَإِنّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَالصِّيَامُ جُنّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ .وَالّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ. لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا: إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبّهُ فَرِحَ بِصَوْمِه.

আল্লাহ তাআলা বলেন, বনী আদমের সকল আমল তার নিজের, কিন্তু রোযা ব্যতিক্রম। রোযা কেবল আমার। আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। রোযা ঢালস্বরূপ। যখন তোমাদের রোযার দিন আসে তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং চিৎকার চেঁচামেচি করবে না। কেউ যদি ঝগড়া বিবাদে প্রবৃত্ত হয় তাহলে সে (নিজেকে নিবৃত্ত রাখবে এবং মনে মনে) ভাববে আমি রোযাদার (প্রয়োজনে মুখে বলে দেবে)। ওই সত্তার কসম, যার কব্জায় মুহাম্মাদের প্রাণ, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেসকের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক প্রিয়। রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল, যখন সে ইফতার করে পুলকিত হয়। অপরটি হল, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন রোযার প্রতিদান পেয়ে খুশি হয়ে যাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪, ১৯০৪, ৭৪৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১

এজন্য খুব গুরুত্বের সাথে রোযা রাখতে হবে, যাতে আমার রোযা আমার তাকওয়ার উপলক্ষ হয়, আমার গুনাহ মাফের মাধ্যম হয় এবং আমার রবের সন্তুষ্টির কারণ হয়। হাদীসে রোযাকে ঢাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমার এ ঢাল যেন অক্ষত থাকে, তা বিদীর্ণ না হয়। হাদীসে  এসেছে, গীবত শেকায়েত মিথ্যা গালাগালি ইত্যাদির মাধ্যমে এ ঢাল নষ্ট হয়ে যায়। (আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪৫৩৬)


শরীয়তে ইসলামীর প্রতিটি আমল ও বিধানের দুটি দিক রয়েছে। বাহ্যিক কানুনী ও আইনি দিক। অপরটি হচ্ছে রূহানী ও আধ্যাত্মিক দিক। রোযার ক্ষেত্রেও তাই। অনেকসময় খেয়াল না করার কারণে কেবল কানুনী বিবেচনাটাই মুখ্য হয়ে থাকে। ফলে দেখা যায়, দিনভর পানাহার থেকে বিরত থাকল বটে, তবে রোযা তার জন্য না ঢাল হল, আর না সে রোযার মাধ্যমে তাকওয়ার কাক্সিক্ষত স্তরে উন্নীত হতে পারল। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزّورِ وَالعَمَلَ بِهِ وَالجَهْلَ، فَلَيْسَ لِلهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ.

যে মিথ্যা ও মূর্খসুলভ বক্তব্য ও আচরণ ছাড়ল না, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৫৭

নবীজী আরো বলেন-

كَمْ مِنْ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلّا الْجُوعُ، وَكَمْ مِنْ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلّا السّهَرُ.

এমন অনেক রোযাদার রয়েছে, ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট ব্যতীত তাদের রোযায় কিছু থাকে না। আবার এমন অনেক রাতের ইবাদতগুজার রয়েছে, রাত্রিজাগরণের কষ্ট ব্যতীত তাদের কিছুই লাভ হয় না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৬৮৫; সুনানে দারেমী, হাদীস ২৭৬২

অতএব রোযা কেবল দুই অঙ্গের নয়। হাত-পা, চোখ, কান, মুখ এবং মন মানসসহ শরীরের সকল অঙ্গের ক্ষেত্রেও রোযার আবেদন রক্ষা করা জরুরি। এমন যেন না হয় যেমনটি বর্ণর্নায় এসেছে। অর্থাৎ ওই দুই নারী, যারা রোযা অবস্থায় গীবত করেছিল। তখন তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে-

إِنّ هَاتَيْنِ صَامَتَا عَمّا أَحَلّ اللهُ لَهُمَا، وَأَفْطَرَتَا عَلَى مَا حَرّمَ اللهُ عَلَيْهِمَا.

এরা দু’জন তো এমন বিষয় থেকে বিরত থেকেছে (অন্য সময়ের জন্য) আল্লাহ যা হালাল করেছেন। কিন্তু ঐসব কাজ থেকে বিরত থাকেনি, যা আল্লাহ (সবসময়ের জন্য) হারাম করেছেন (অর্থাৎ গীবত)। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৬৫৩

মোটকথা, তাকওয়া ও ক্ষমা লাভের প্রতিবন্ধক বিষয়গুলোকে বর্জন করে তাকওয়া অর্জনে এগিয়ে এলে তবেই রোযা ঢাল এবং তাকওয়া অর্জনে সহায়ক হবে, ইনশাআল্লাহ।