শীর্ষ খেলাপি এখন বেক্সিমকো, এস আলম
৫ ব্যাংকে ১০ গ্রুপেরই ৫২০০০ কোটি টাকা আটকে
বছরের পর বছর ঋণ নিতে পেয়েছে নানা সুবিধা, পরে সেই টাকা পরিশোধ না করতেও অকাতরে দেওয়া হয়েছে একের পর এক ছাড়; ফলাফল পাঁচ ব্যাংকে খেলাপির শীর্ষ ১০ শিল্পগোষ্ঠীর দায় গিয়ে ঠেকেছে ৫২ হাজার কোটি টাকায়।
সরকারের পালাবদলের পর ব্যাংক খাতের গোপন অনেক বোঝাপড়া প্রকাশ্যে আসতে শুরু করলে ঋণ খেলাপির তালিকাতেও বিস্তর ওলটপালট হয়েছে; দেড় দশক ধরে খেলাপি না থাকা বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপ এক লাফে চলে এসেছে তালিকার শীর্ষে।
শীর্ষ দশের মধ্যে কয়েকটি আগে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশের ব্যবসায়িক জগতে অল্প পরিচিত তিনটি কোম্পানির নাম তালিকার উপরের দিকে দেখে বিস্ময় জাগছে অনেকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক তালিকায় শীর্ষ ১০ ঋণ খেলাপি এবং সেগুলোকে উদার হাতে টাকা দিয়ে যাওয়া এসব ব্যাংকের নাম এসেছে।
এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী হিসেবে আলোচিত বেক্সিমকো ও এস আলম ছাড়াও পুরনো খেলাপি অ্যানোনটেক্স, ক্রিসেন্ট ও রতনপুর গ্রুপের নাম রয়েছে।
দুই বছর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সংসদে আগের সরকারের আমলে প্রকাশ করা শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় বেক্সিমকো ও এস আলমসহ এর ছয় গ্রুপের নামই ছিল না।
খেলাপির শীর্ষ ১০
>> বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, অ্যানোনটেক্স, মাইশা, এফএমসি, ক্রিসেন্ট, রতনপুর গ্রুপ, জাকিয়া গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও রাঙ্কা গ্রুপ।
>> মোট খেলাপি ৫১ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণে ধুঁকতে থাকা শীর্ষ ৫ ব্যাংক
>> জনতা, অগ্রণী, সোনালী, ন্যাশনাল ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
খেলাপির বোঝায় চাপা শীর্ষ ১০ ব্যাংক
>> জনতা, ন্যাশনাল, অগ্রণী, এবি, রূপালী, সোনালী, ইউনিয়ন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, আল আরাফাহ ইসলামী ও ট্রাস্ট ব্যাংক।
>> এসব ব্যাংকে ১০০ কোটির ওপর খেলাপি ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
>> এসব ব্যাংকে ১০০ কোটির কম-বেশি সব মিলিয়ে মোট খেলাপি ১ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।
>> এই পরিমাণ ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৪৬ শতাংশ।
>> ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে মোট খেলাপি ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
>> দেশের ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৩৬টিতে ১০০ কোটি টাকার ওপর মোট খেলাপি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
>> এই অর্থ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের মোট খেলাপি ঋণের ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ।
১০০ কোটির ওপর খেলাপি
>> এমন কোম্পানি সবচেয়ে বেশি জনতা ব্যাংকে; ৫২ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। আর ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।
>> দ্বিতীয় অবস্থানে ন্যাশনাল ব্যাংক; ২১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা।
>> তালিকায় তৃতীয় অগ্রণী ব্যাংক; ১৫ হাজার ৬২৮ কোটি। ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ ২৬ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটিসহ পাঁচ ব্যাংক থেকে শীর্ষ খেলাপি শিল্পগোষ্ঠীর কোম্পানি বা সুবিধাভাগী কোম্পানিকে (সরাসরি গ্রুপের কোম্পানি হিসেবে নামা না থাকা) বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণসীমাসহ অনেক নিয়ম কানুনই মানা হয়নি বলে অভিযোগ ব্যাংকারদের।
তারা বলছেন, গ্রুপগুলো কাগজপত্র ঠিক রেখে কাগুজে কোম্পানি খুলে টাকা বের করতে নানা কৌশল করেছে। এসব ঋণের সুবিধাভোগী কারা তা ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও কর্মকর্তারা ঠিকই জানতেন বলে তারা যাচাই বাছাই করার প্রয়োজনও মনে করেননি।
জনতা ব্যাংকের সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অন্য কর্মকর্তাদের কথাতেও তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তথ্য নিয়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক ধরে ১০০ কোটির ওপর খেলাপি রয়েছে এমন শীর্ষ ১০ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০ গ্রুপের তালিকা করা হয়েছে। এছাড়া শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকাও করা হয়েছে যেগুলোর দেওয়া ১০০ কোটি টাকারে বেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে।
তারা বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তালিকা হালনাগাদ হওয়ায় খেলাপি ঋণের নতুন এ তথ্য সামনে এসেছে। আগের সরকারের আমলের বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং ফাঁকির তথ্য সামনে আসায় নতুন গ্রুপ ও কোম্পানির নাম যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১০০ কোটি টাকার ওপর খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ৩৬টি ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ তালিকা করা হয়েছে।
এখন এসব ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে তাও জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়ার কথা বলেন তিনি।
আটটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে তথ্য পাঠানোর বিষিয়টি এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে তাগাদা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পাওয়ার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন।
এতদিন কাগজেপত্রে খেলাপি না হলেও এবার তালিকার শীর্ষ নাম বেক্সিমকো গ্রুপের। এ গ্রুপের শিল্প পার্কের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির তথ্য বলছে, গ্রুপটির মোট ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ২৩ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই এখন খেলাপি।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়কার সুবিধাভোগী হিসেবে আলোচিত তার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। বেক্সিমকোর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে তার নামে শেয়ার কম হলেও বড় ভাই সোহেল রহমানকে নিয়ে তিনিই গ্রুপের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করতেন।
শীর্ষ ১০ খেলাপি
গ্রুপ |
ব্যাংক |
টাকা (কোটি টাকায়) |
বেক্সিমকো গ্রুপ |
জনতায় (১৯৩৭২.১৪ কোটি টাকা), সোনালীতে (১৪২৪.৬২ কোটি টাকা) |
২০,৭৯৬.৭৬ |
এস আলম গ্রুপ |
জনতায় (৯২৭২.৬৫ কোটি টাকা) ও ইউনিয়নে (২৪৬১.৬১ কোটি টাকা) |
১১,৭৩৪.২৬ |
এননটেক্স গ্রুপ |
জনতা ব্যাংকে |
৭,৬৮৬.১৫ |
মাইশা গ্রুপ |
ন্যাশনাল ব্যাংকে |
২,৭৫৪.৫০ |
এফএমসি গ্রুপ |
ন্যাশনাল ব্যাংকে |
২,১৪৩.৫৮ |
ক্রিসেন্ট গ্রুপ |
জনতা ব্যাংকে |
২,০৩৮.৫৯ |
রতনপুর গ্রুপ |
জনতা ব্যাংকে |
১,২২৬.৯১ |
জাকিয়া গ্রুপ |
অগ্রণী ব্যাংকে |
১,২০৯.৯৮ |
রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডে |
জনতা ব্যাংকে |
১,১৩৩.৯০ |
রানকা গ্রুপ |
জনতা ব্যাংকে |
১,১৩১.৮৬ |
|
মোট |
৫১,৮৫৬.৪৯ |
দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রুপটিকে অকাতরে ঋণ বিলিয়েছে জনতা ব্যাংক। এ ব্যাংকে ২০২৩ সালে দায়িত্বে আসা সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টেফোর ডটকমকে বলেন, “এসব ঋণ যে বেক্সিমকোর সেটা বোঝাও যেত না। আমি আসার পরে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়টি অবহিত করেছি। এরপর সব প্রতিষ্ঠানকে একটি গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। তখনই একক ঋণ সীমা অতিক্রম হয়।”
কোনো একক গ্রাহককে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও ননফান্ডেড) বেশি ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই।
আব্দুল জব্বারের ভাষ্য, সীমার চাইতে সাড়ে ৮০০ গুণ বেশি ঋণ দেওয়া হয় বেক্সিমকোর এসব কোম্পানিকে। বাংলাদেশ ব্যাংককে তা অবহিত করেন তিনি।
তার দাবি, এমডির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এ নিয়ে সালমান রহমানের সঙ্গে অনেকবার আলোচনাও করেছেন। সীমার বাইরে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ওই সময়ের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকেও তিনি বিষয়টি জানিয়েছেন।
খেলাপির নতুন তথ্য সামনে এল যেভাবে
সরকারের পালাবদলে নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ তদারকির অংশ হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ‘স্পেশাল মনিটরিং সেল’ গঠন করে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একজন ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এটির প্রধান করা হয়। এ সেল ১০০ কোটি টাকার ওপরের খেলাপি ঋণের তথ্য খুঁজে বের করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, ১০০ কোটি টাকা এবং তদূর্ধ্ব স্থিতির ‘শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ও ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কমিয়ে আনতে’ স্পেশাল মনিটরিং টিম কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে বক্তব্য দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
“মূলত ১০০ কোটি টাকার ওপর খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ৩৬টি ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে চেয়েছে সামনে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
এরমধ্যে যেসব ব্যাংকে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ বেশি সেগুলোতে যাতে নতুন করে আবার ‘শ্রেণিকৃত’ (খেলাপি) না সেজন্য নিবিড় তদারকি করে নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায় নিশ্চিত করতে পরামর্শ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
১০০ কোটির ওপর খেলাপি ঋণের শীর্ষ ১০ ব্যাংক
ব্যাংকের নাম |
খেলাপি ঋণ (কোটি টাকায়) |
১০০ কোটি বা এর বেশি খেলাপি ঋণের মোট স্থিতি |
জনতা |
৬০,৩৪৫.৩০ |
৫২,৩৯৬.১৪ |
ন্যাশনাল |
২৩,৭২১.৯১ |
২১,০৫৬.৫২ |
অগ্রণী |
২৬,৮৯১.৭৮ |
১৫,৬২৮.১৫ |
এবি |
১০,১১৫.৬৫ |
৮,৫২৬.১২ |
রূপালি |
১২,৭৩৪.৭৪ |
৮,১৬৪.৫৭ |
সোনালী |
১৬,৫৬৫.৩০ |
৭,১৪৪.১৩ |
ইউনিয়ন |
১২,২১৭.৮৬ |
৬,৪৮৪.৪৮ |
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি |
১২,৯৪৮.১৩ |
৬,২০৬.৭৭ |
আল আরাফাহ ইসলামি |
৪,৯০৫.১৭ |
২,৩০৪.৩৩ |
ট্রাস্ট |
২,৭৫২.৬৪ |
২,২৯৯.২৫ |
বৃহৎ শিল্প গ্রুপের কাছ ঋণ আদায়ে আইনগত জটিলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আদালতের স্থগিতাদেশ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব, ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছা প্রভৃতি কারণে ঋণ আদায় প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও কঠিন হয়ে থাকে।
“বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকসমূহকে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে আদায় হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, খেলাপি ঋণ আদায়ে দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করা এবং প্রয়োজনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি ব্যবহারে ব্যাংকসমূহকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
খেলাপির তালিকায় নতুন নাম কেন?
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেগুলোর মোট ১৯ হাজার ২৮৪ কোটি ঋণের মধ্যে ১৬ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা খেলাপির তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। ২০ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলেও মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা সাত লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ ব্যক্তি ও কোম্পানি বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
এর দেড় বছরের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের নতুন প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্য ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে তালিকা তৈরি করেছে সেটির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর ওই তালিকার ফারাক অনেক। আগের তালিকা বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের নাম ছিল না।
বর্তমান তালিকায় অর্থমন্ত্রীর প্রকাশ করা মাইশা, রিমেক্স ফুটওয়্যার, এফএমসির সিএলসি পাওয়ার ও ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টের নাম রয়েছে।
৩৬ ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকর বেশি মোট খেলাপি ঋণ
ব্যাংক |
মোট ঋণ (কোটি টাকা) |
খেলাপি ঋণ (কোটি টাকা) |
১০০ কোটির বেশি ঋণ (কোটি টাকা) |
১০০ কোটি টাকার বেশি ঋণের হার |
|
ক |
খ |
গ |
ঘ=(গ/খ*১০০) |
রাষ্ট্রায়ত্ত (৫টি) |
৩১২,৫৫৪.৬৮ |
১২৬,১১১.৫২ |
৮৩,৮৪৭.০৮ |
৬৬.৪৯% |
বেসরকারি (২৮টি) |
১,২৬১,২২৯.৮৮ |
১৪৯,৮০৬.৩৩ |
৬২,৩২৫.৮৭ |
৪১.৬০% |
বিদেশি (২টি) |
৬৫,০৩৪.০৭ |
৩,২৪৫.৬৩ |
৩২৮.৯৭ |
১০.১৪% |
বিশেষায়িত (১টি) |
৪৪,০০৩.৩০ |
৫,৮১৩.৮৩ |
৮৩২.২৭ |
১৪.৩২% |
মোট(৩৬ টি) |
১,৬৮২,৮২১.৯৪ |
২৮৪,৯৭৭.৩১ |
১৪৭,৩৩৪.১৯ |
৫১.৭০% |
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর আসল ঘটনা সামনে আসছে। কারণ এসব গ্রুপ বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে। বড় ঋণ গ্রহীতাদের পুনতফসিলের ছাড় সুবিধার পরও অনেক কোম্পানি কিস্তি পরিশোধ না করলেও ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের খেলাপি দেখাত না। সঠিক তথ্যও বাংলাদেশ ব্যাংকে দিত না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রভাবশালীদের চাপে বিভিন্ন সময় এসব ব্যাংকে পরিদর্শন দলও পাঠাত না।
এখন ব্যাংকগুলোতে সেসব গ্রুপের প্রভাব না থাকায় এবং অনেকগুলোতে নতুন পর্ষদ আসায় বেক্সিমকো ও এস আলমের মত বড় গ্রুপের নিজেদের কোম্পানির নামে কিংবা অন্য কোনো কোম্পানির নাম দিয়ে নেওয়া ঋণের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, গত সরকারের আমলে প্রভাবশালী গ্রুপগুলোর বিষয়ে ‘আগে থেকেই নির্ধারণ’ করে দেওয়াছিল এসব গ্রুপকে খেলাপির অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
“এজন্য ব্যাংকগুলো যা করা দরকার সেগুলো করেছে। কী করলে খেলাপির তালিকায় নাম থাকবে না সেসব করা হয়েছে। তথ্য লুকিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সঠিকভাবে তথ্য দেয়নি।”
তিনি বলেন, “তখন এসব গ্রুপ অনেক প্রভাবশালী ছিল। উচ্চ পর্যায়ে যেমন প্রাইম মিনিস্টার্স অফিস, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ওই ধরনের অবস্থায় তালিকায় তাদের নাম রাখাটা খুব কঠিন ছিল।
“যেটা করত সেটা হল খেলাপি হলে সেই তালিকায় নেওয়ার আগেই পুনঃতফসিলি করে ঋণটি নিয়মিত করে ফেলত। যাতে খেলাপির খাতায় ঢোকার কোনো টেকনিক্যাল কারণ না থাকে।”
উদাহরণ হিসেবে জাহিদ হোসেন বলেন, “২০২২ সালে যেমন আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই ঋণ পুনঃতফসিলের ঢালাও সুবিধা প্রদান করেন। তাতে অনেক খেলাপি সেসময় অল্প টাকা দিয়েই খেলাপি হওয়া থেকে বেঁচে যান।”
বেক্সিমকোর ২৯ অ্যাকাউন্টে ১০০ কোটির বেশি খেলাপি
দেশের ব্যবসায়িক খাতের আলোচিত নাম বেক্সিমকো রয়েছে ১০০ কোটি টাকার ওপর ঋণ খেলাপির শীর্ষে; বিভিন্ন ব্যাংকে যার মোট পরিমাণ ২০ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে জনতা ব্যাংকেই ১৯ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকে ১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান রহমান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলে ব্যাংকগুলো এ শিল্পগোষ্ঠীর নামে এবং সুবিধাভোগী হিসেবে বিভিন্ন নামের কোম্পানি খুলে নেওয়া ঋণকে খেলাপি হিসেবে দেখিয়েছে। এখন এসব ঋণ আদায় নিয়ে জটিলতায় পড়েছে ব্যাংকগুলো।
এ গ্রুপকে সবেচেয়ে বেশি ঋণ দিয়ে ধুঁকতে থাকা জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য বলছে, বেক্সিমকো গ্রুপের ২৯টি কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ১০০ কোটির ওপর খেলাপি ঋণ রয়েছে। তবে এগুলো ছাড়া আরও কিছু অ্যাকাউন্ট রয়েছে যেগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার নিচে। সেই সংখ্যা বের করতে কাজ চলার কথা বলেন তিনি।
জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আব্দুল জব্বার বলেন, এ ব্যাংক থেকে বেক্সিমকোর ঋণ নেওয়া শুরু ১৯৭৮ সালে। তবে ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত গ্রুপটি বিভিন্ন ঋণ পুনঃতফসিল করলেও নতুন কোম্পানি খুলে ঋণ নেওয়ার ঘটনা ঘটায়নি। নতুন এ কৌশলে বিভিন্ন ধরনের কোম্পানি তৈরি করে ব্যাংকটি থেকে টাকা বের করে নেওয়া শুরু হয় এরপর থেকে। তবে ২০১৬ সালের পর থেকে এ ধরনের অনিয়ম ও কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অন্য কোম্পানির নামে নেওয়া এসব ঋণ বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ঘুরে বেক্সিমকোর কাছে যাওয়ার বিষয়টি জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেসময় বুঝতে পারেনি। কেননা ব্যাংক থেকে কিছু জানানো হয়নি।
বেক্সিমকো শিল্প পার্কের অবস্থা পর্যালোচনায় গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রধান শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনও গ্রুপের অস্তিত্বহীন কোম্পানি পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন।
শিল্প পার্কে অবস্থিত ৩২টি কারখানার মধ্যে ১৬টি কোম্পানির ‘অস্তিত্ব না’ থাকার প্রমাণ কমিটি পেয়েছে বলে গত ২৩ জানুয়ারি তুলে ধরেন তিনি।
এ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, এসব অস্তিত্বহীন কোম্পিানির নামে বেক্সিমকো গ্রুপের ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
পার্কে অবস্থিত ৩২টি কারখানার বিপরীতে ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকাসহ বেক্সিমকো লিমিটেডের মোট ব্যাংক ঋণ বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকের পাওনা ২৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা বলে জানান উপদেষ্টা।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের এমডি ছিলেন আব্দুস ছালাম। এ ছয় বছরেও ব্যাংকটি থেকে বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নেয় বেক্সিমকো। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
এরপর জনতার এমডি হন আবদুল জব্বার। তার দাবি, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বেক্সিমকো যে বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে তা তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানান।
তার ভাষ্য, “বিশেষ করে প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঋণ নেয় এসব প্রতিষ্ঠান। জনতা এসব ঋণ দিলেও পরে তা খেলাপি হয়েছে। যদিও সুদের কিছু টাকা জমা দিত। তারপরে আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিত।”
ঋণ খেলাপির তালিকায় বেক্সিমকোর নাম আসা এবং জনতা ব্যাংকে গ্রুপটির ১০০ কোটির ওপর ১৯ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গ্রুপটির তরফে বলা হয়, "টাকা পরিশোধের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নের উপর কাজ চলমান রয়েছে। শীঘ্রই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।“
এক জনতাতেই ৯ হাজার কোটি টাকা খেলাপি এস আলমের
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী আরেক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেকগুলো বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ। এসব ব্যাংক থেকে বিভিন্ন কায়দায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি বের করে নেওয়ার কথা বলে আসছেন গভর্নর আহসান মনসুর।
এর বাইরে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও তা পরিশোধ করেনি চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি। এতে করে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় দ্বিতীয় অব্স্থানে নাম চলে এসেছে গ্রুপটির। গত দেড় দশকে এ গ্রুপের নামও কখনও খেলাপির তালিকায় ওঠেনি।
গ্রুপটির ১০০ কোটি টাকার ওপর মোট খেলাপি ঋণ ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।
বেসরকারি চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক ইউনিয়নের পর্ষদ এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপান পরিচালক মো. সাইফুল আলমের (এস আলম) পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, জনতায় এস আলম গ্রুপের ১৬টি কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ১০০ কোটির ওপর খেলাপি হয়েছে। এগুলো ছাড়াও ১০০ কোটি টাকার নিচে থাকা আরও কিছু অ্যাকাউন্টের ঋণ খেলাপি হয়েছে, যা বের করার কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেওযা তথ্য বলছে, বছরের পর বছর ধরে এস আলম জনতা থেকে সীমার অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে। এরমধ্যে ২০০৫, ২০০৯, ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে বিভিন্ন কোম্পানির নামে ৭ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। এছাড়া এস আলম কোল্ড রোলড স্টিলস ২০১০, ২০২০ ও ২০২১ সালে ১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকার ঋণ নেয়, যার সবগুলোই এখন খেলাপি।
এস আলম গ্রুপের উপব্যবস্থাপক আশিস কুমার নাথের দাবি, তাদের কারখানাগুলো সচল থাকলে খেলাপির টাকা ফেরত দিতে পারবেন। তবে জনতা ব্যাংকে অনিয়মের মাধ্যমে নেওয়া ঋণের বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
ডলারের অভাবে নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা বন্ধ থাকায় কাঁচামালের অভাবে অধিকাংশ কারখানা উৎপাদন বন্ধ থাকার তথ্য দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো বলছে আমদানি করতে ১০০ শতাংশ মার্জিন রাখতে হবে। সেটা আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব নয়।”
অ্যাননটেক্স নিয়েও ভুগছে জনতা
জনতা ব্যাংক থেকে দেদারসে অর্থ নিয়ে নয়ছয় করা আলোচিত পোশাক খাতের অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। গ্রুপের ১৯টি কোম্পানির অ্যাকাউন্টের খেলাপি ১০০ কোটির ওপর।
ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে এ ব্যাংক থেকে এ গ্রুপের কোম্পানি গ্যালাক্সি সোয়েটার্স অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িংয়ের নামে প্রথম ঋণ পায়, যেটির পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি টাকা। প্রথম দিকে ঋণের টাকা পরিশোধও করেন তিনি। পরে ঋণ বাড়তে থাকে এ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে, যেগুলোর প্রায় সবই পোশাক ও বস্ত্র খাতের।
একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রম করলেও এ গ্রুপের কোম্পানিকে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নেয়নি জনতা ব্যাংক।
এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনুস বাদলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
মাইশা ও এফএমসিতে ধরা ন্যাশনাল ব্যাংক
বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের অন্যতম ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান দুর্দশার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে প্রধান হল আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আসলামুল হকের কোম্পানি মাইশা গ্রুপকে দেদারসে দেওয়া বিপুল ঋণ। সবশেষ হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আসলামুল হকের মৃত্যুর পর মাইশা গ্রুপ মূলত খেলাপিতে পড়ে। মর্টগেজে থাকা সম্পত্তি নিলামে তোলার জন্য কাজ শুরু হয়েছে। গ্রুপের জমিগুলোর সার্ভেও করা হয়েছে।
আসলামুল হকের মৃত্যুর পর ২০২১ সালে ব্যবসার হাল ধরে তার স্ত্রী মাকসুদা হক দায়ের সব টাকা দিতে পারবেন না বলে বিভিন্ন ব্যাংককে জানিয়ে দেন।
খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের বর্তমান উদ্যোগের বিষয়ে জানতে মাকসুদা হকের বক্তব্য মেলেনি।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ। এরপর থেকেই ব্যাংক মাইশা ছাড়া আরও ব্যাপক আকারে ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে।
এরমধ্যে অন্যতম আরেকটি গ্রুপ চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ মেরামতকারী কোম্পানি এফএমসি গ্রুপ। এটির আরও অন্যান্য খাতে ব্যবসা রয়েছে। এটির চেয়ারম্যান ইয়াসিন চৌধুরী।
ন্যাশনাল ব্যাংকে এফএমসি গ্রুপের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এফএমসির ডকইয়ার্ড কোম্পানিটিকে ‘ইচ্ছাকৃত’ খেলাপি গ্রহিতা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ব্যাংকটি। অর্থ ঋণ আদালতে মামলাও হয়েছে।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকে থাকা ডকইয়ার্ড কোম্পানিটির কর্মকর্তা মোর্শেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমি ফোন কেটে দিচ্ছি।”
এরপর তিনি ফোন কেটে দেন। পরে আর ধরেননি। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান ইয়াসিন চৌধুরীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা চামড়া খাতের ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড, ইস্পাত খাতের ব্যবসা থাকা রতনপুর গ্রুপ এবং তৈরি পোশাক খাতের রানকা গ্রুপের খেলাপি ঋণ ফুলে ফেঁপে উঠেছে জনতা ব্যাংকে।
অপরদিকে বস্ত্র খাতের নরসিংদীভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী জাকিয়া গ্রুপকে ঋণ দিয়ে চাপে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক ব্যাংক অগ্রণী।
কী বলছে ব্যাংকগুলো
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১০০ কোটির ওপর খেলাপি ঋণগুলো দ্রুত আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। সেজন্য তৈরি করা আলাদা বিভাগ তা মনিটরিং করছে।
অর্থ আদায়ে এস আলমের সম্পত্তি নিলামে তোলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আবার মামলাও চলছে। আদালতকে নিয়মিত জানানো হচ্ছে।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ফেরা আব্দুল আওয়াল মিন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ চলছে। ১০০ কোটি টাকার ওপরের খেলাপিদের থেকে আদায়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সামনে বিস্তারিত কথা বলবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আগের ম্যানেজমেন্টে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। সেই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। সেসময় ব্যাংকটি থেকে অনেক গ্রুপ ১০০ কোটির ওপর ঋণ নিয়েছে। তারা এখন খেলাপি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, বিভিন্ন গ্রুপ গত ১৫ বছর ব্যাংকখাত তছনছ করে দিয়েছে। ওই সময় অনেক সফল ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋন পাননি। অথচ প্রভাবশালীরা ১০০ থেকে ৫০০ কোটির ওপর ঋণ নিয়ে বসে ছিল, যারা খেলাপি হওয়ায় ব্যাংক আর্থিক সংকটে ভুগছে।
“কীভাবে খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করা যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে।”
এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান বিডিনিইউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পট পরিবর্তনের পর থেকে প্রভাবশালী গ্রুপের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে আগে সহযোগিতা তারা করতেন না, তবে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর সহায়তা করছে। তাই আমরা খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করতে পারছি।”