শুল্ক-কর না বাড়িয়ে কী করতে পারত সরকার?
অর্থনীতিতে যখন ‘অস্থির সময়’ চলছে, আইএমএফের ঋণের শর্ত প্রতিপালনে রাজস্ব আদায় বাড়াতে তখন সবচেয়ে সহজ পথ শুল্ক ও কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার; প্রশ্ন উঠেছে, অর্থবছরের মাঝপথে এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকার অন্যভাবে এর সমাধান করতে পারত কি না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের চাপে শতাধিক পণ্য ও সেবার আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।
বৃহস্পতিবার রাতে এ সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশ জারির পরপরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে; এতে তা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে।
শুল্ক-কর বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এসব পণ্যের দাম বেড়েছে, যা লাগামহীন মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। তাতে সাধারণ মানুষের খরচের বোঝা আরও বাড়বে।
প্রথমে যখন ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তখন কর আদায়ের সংস্থা এনবিআর দাবি করেছিল, এর ফলে মূল্যস্ফীতিতে ‘প্রভাব পড়বে না’।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সুরও ছিল একই; অথচ এ অর্থনীতিবিদও সরকারে দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে এনবিআরের কর আদায়ের ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও ফাঁকির প্রশ্নে সমালোচনা করে আসছিলেন। দায়িত্ব নিয়েও তিনি এনবিআরের বিভিন্ন আলোচনায় একই মত প্রকাশ করে আসছিলেন।
অর্থ উপদেষ্টা ও এনবিআরের এ অবস্থানের সমালোচনা করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তার ভাষায়, এটা ‘দিনকে রাত বলার মত’।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে আইএমএফের সঙ্গে দর কষাকষিতে অর্থ বিভাগের ‘দুর্বলতা’ ছিল বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, “অর্থ বিভাগের তো দায়িত্ব নেগোসিয়েশন করার, তারা ঠিকমত করে নাই।”
এ সময়ে আইএমএফ এর ওই চাপ কেন মেনে নেওয়া হল, সেই প্রশ্নও রেখেছেন জাহিদ হোসেন।
চাপ বাড়ল যেভাবে
জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন ও অগাস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, পাঁচ মাস পরেও রাজস্ব আদায়ে তার প্রভাব রয়ে গেছে।
রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির খবর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই এসেছিল; চার মাস, এমনকি পাঁচমাসেও এ ধারা থেকে বের হতে পারেনি এনবিআর।
সবশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এনবিআর গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৬২ শতাংশ কম রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে, যেখানে আগের বছর একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।
কেবল চলতি অর্থবছরের নভেম্বরেই গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফের পরবর্তী কিস্তি পেতে কঠোর শর্ত। গত অর্থবছরে আন্তর্জাতিক এ সহযোগী সংস্থার দেওয়া শর্ত পূরণ করতে না পারায় চাপ তৈরি হয় চলতি অর্থবছরে।
আইএমএফের ঋণ চুক্তিতে বলা হয়েছে, এনবিআরকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে কর আহরণ ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ০.৭ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি দেখতে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঢাকা আসে আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল।
তখন সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর চলতি অর্থবছরের জন্য আগের দেওয়া শর্ত শিথিল করে কর-জিডিপি অনুপাত ০.৪ শতাংশ পয়েন্ট বাড়ানোর সুযোগ চেয়েছিল।
আইএমএফ সেই প্রস্তাবে রাজি হলেও গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও এনবিআর শর্ত পূরণ করতে না পারায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়তি আরও ০.২ শতাংশ পয়েন্ট বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেয়।
গত অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অনুবিভাগ ছাড়া আয়কর ও শুল্ক অনুবিভাগ আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এ নিয়েও আইএমএফের আগের সফরে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কর্মকর্তাদের।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আয়কর অনুবিভাগে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ছিল; আর আদায় করতে পারে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম বলেন, “আইএমএফ যে দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে বলছে, তা গত অর্থবছরের লক্ষ্যের ওপর বৃদ্ধি; আমরা কত আদায় করতে পেরেছি, তা না। এতে চাপ বেড়েছে।”
আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, এই ১২ হাজার কোটি টাকা ভাগ করে ২ হাজার কোটি টাকা আয়কর অনুবিভাগে, ২ হাজার কোটি টাকা শুল্কে এবং ৮ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট অনুবিভাগের মাধ্যমে আদায়ের পরিকল্পনা তারা আইএমএফকে দেখিয়েছিলেন।
আর কী করা যেত
অর্থ পাচার রোধ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, কর ফাঁকি কমানো, অনিয়ম ও দুর্নীতির মত বিষয় বাদ দিয়ে কেন পুরনো পথেই হাঁটতে হল, জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বাস্তবতা হচ্ছে, জুনের মধ্যেই অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
“দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারের তো আর ফল স্বল্প মেয়াদে পাওয়া যাবে না, তাই এটা নেওয়া। তাছাড়া আয়কর বছরের মাঝে বাড়িয়েও আদায় বাড়ে না, যেহেতু পূর্বের অর্থবছরের আয়ের ওপর এটা দেওয়া হয়। সহজ হিসেবে শুল্ক-কর বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছে।”
তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলে বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে, টাইমিংটা সঠিক কিনা। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে এটি না করে আইএমএফের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করা যেত। আমার মনে হয়, আমাদের কর্মকর্তাদের দুর্বলতা ছিল।
“আইএমএফ চায় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর মাধ্যমে বাজেট ঘাটতি কমানো হোক। কিন্তু বাজেট ঘাটতি তো ব্যয় কমিয়েও করা যায়। ব্যয় কমানোর বিষয়টি তারা মানেনি। এক্ষেত্রে এভাবে নেগোসিয়েশন করা যেত যে, কিছু আদায় বাড়াব আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে যে অপচয়মূলক প্রকল্প আছে সেটি বাদ দেব।”
সিগারেট থেকে বাড়তি ৪ হাজার কোটি টাকা কর আদায়ের লক্ষ্য ধরা এবং এখন প্রয়োজন নেই– এমন কিছু প্রকল্প বাদ দিলেই এ ধাক্কা সামলানো যেত বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় সিগারেটে কর বসানো আর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ওষধে কর বসানোর সিদ্ধান্ত ‘সাংঘর্ষিক’ হয়ে গেল।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ভ্যাটের কারণে ওষুধের দাম বাড়বে না। দাম বাড়ার কারণ অন্য।”
ওষুধ উৎপাদনে এক টাকা খরচ হলে ‘চার টাকায় বিক্রি হয়’ বলেও তিনি দাবি করেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানও ভ্যাট বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়াকে ভ্যাট বসানো নয় বরং ‘যৌক্তিকীকরণ’ করা হয়েছে দাবি করেছেন।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান প্রশ্ন তুলে বলেন, “১২ হাজার কোটি টাকা আইএমএফের চাপে রাজস্ব বাড়াতে হবে কেন?
“সরকার বলছে, এর মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়াচ্ছে। তারা আয় বাড়াচ্ছে না, আমার খরচ বাড়াচ্ছেন।”
কীভাবে এ সমস্যা সামলানো যেত প্রশ্ন করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতদিন তো উন্নয়নের সাগরে ভাসছিল দেশ; এখন খরচ কমায়া দিলেই পারে। ব্যবসায়ীদের ব্রিজ, রোড, কালভার্ট দরকার নাই। তারা চায় ঠিকঠাক বিদ্যুৎ পাক। গ্যাস পাক।
“আপনি (সরকার) বিদ্যুৎ দেন, গ্যাস দেন, আমরা দরকারে ফেরি করে আমাদের পণ্য সরবরাহ করব। এসব প্রকল্পের খরচ কমান। এডিপিতে খরচ কমিয়ে দুই লাখ কোটি টাকায় নামিয়ে ফেলেন।”
খরচ কমানোর পথে না হেঁটে ভ্যাট বাড়ানোর সমালোচনা করে রিজওয়ান বলেন, “একজন সরকারি কর্মকর্তার কেন ৪২ কোটি টাকার বাড়ি লাগবে? কেন মুখ্য সচিবের বাসায় ৩৭ জন কর্মচারী প্রয়োজন? কেন কেবিনেট সেক্রেটারির বাসায় দুইটা সুইমিং পুল থাকবে?
“আমি তো তৃতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ী। কই, আমার বাসায় তো একটা সুইমিং পুল হয় না। কোভিড পরবর্তী সময়ে বেসরকারি খাতে বহু কর্মীর বেতন কমানো হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছে। কেউ কেউ বছরের পর বছর একই বেতনে চাকরি করে যাচ্ছেন। আন্দোলন করারও সুযোগ নাই। কোথায় যাবেন? সবখানেই একই অবস্থা।”
এই মুহূর্তে সরকারের ৩০ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন এ ব্যবসায়ী।
সরকারি চাকরিজীবীরা ‘নিজেদের সুবিধা কমাবেন না বলেই’ আইএমএফের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারেননি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বলতা হল দর কষাকষিতে।”
সরকারের পরিচালন ব্যয় কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাকও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পৃথিবীতে যেসব দেশে এ ধরনের ক্রাইসিস হয়, তারা যেটা করে, তা হল- তার অপারেটিং কস্ট কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো দেশে এটি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হয়।
“এমনও হয়েছে যে, সরকার খরচ কমাতে তার বিল্ডিং বিক্রি করে ভাড়া বাসায় অফিস নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন এক ফোর্স আছে, যার ফলে অপারেটিং কস্ট কমানো যাচ্ছে না।”
একই সঙ্গে আইএমএফ এর সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশন' করতে না পারাকেও ‘দুর্বলতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির সাবেক প্রধান এম এ রাজ্জাক।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, সরকারের ইমেডিয়েটলি রাজস্ব দরকার। এক্ষেত্রে আইএমএফের চাপ আছে যেমন সত্যি, তেমনই দেশের রাজস্ব দরকার সেটাও সত্যি।
“উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নেওয়া ঋণ পরিশোধ ও সুদ দিতেই রাজস্ব আদায়ের ৩০ শতাংশ অর্থ খরচ হয়। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কম। আগে লোন নিয়ে এটা সামলানো যেত। এখন আবার যে ঋণ করে এটা সামলাবে, সেটাও সম্ভব না। কারণ এখন সংকোচন নীতি চলছে। ব্যাংক ঋণের সুদ বেশি দিতে হবে।”
এমন পরিস্থিতিতে ‘মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়লেও দ্রুত রাজস্ব বাড়াতে সরকারের হাতে বিকল্প কম’ ছিল বলে তিনি মনে করেন।
রাজ্জাক বলেন, “অলটারনেটিভ ছিল, কর জাল বাড়ানো। কিন্তু খুব দ্রুত এ অর্থ আদায় সম্ভব না। সম্পদ কর করা যেত, কিন্তু দরকার এই মুহূর্তে। এসব দিয়ে তাড়াতাড়ি তা পারত না।”
সরকার কেন কর ফাঁকি না কমিয়ে বা সংস্কারের পথে না হেঁটে শুল্ক-কর বাড়ানার পথ বেছে নিল, সেই প্রশ্নে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া রাজস্ব সংস্কার সম্ভব নয়। এটাও সংস্কারের একটা অংশ। আগে ভ্যাট কমিয়ে রেখে অব্যাহতি দেওয়া ছিল। এখন সংস্কার হচ্ছে।
“কিন্তু টাইমিং একটা ফ্যাক্টর। সবকিছু সুচিন্তিত হচ্ছে না। এই মুহূর্তে মহার্ঘ্য ভাতা দিবেন না, এ সিদ্ধান্ত নেওয়াও উচিৎ ছিল। ওয়েট করা যেত। অপারেটিং বাজেট কমানো যেত। অনেক জায়গায় হাত দেওয়ার ছিল।”
মূল্যস্ফীতি ‘বাড়বে’
গত দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতি চাপে নাজেহাল। মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে বারবার সুদের হার বাড়ানো হলেও সুফল মেলেনি নিত্যপণ্যের বাজারে।
এর মধ্যে নতুন বছরে বিস্কুট, ওষুধ, আমদানি করা ফল, ফলের রস, সাবান, সাবান জাতীয় পণ্য, পোশাক কেনাকাটা, মিষ্টি, বেশ কয়েক ধররেনর টিস্যু, মোটর গাড়ির গ্যারেজ, এলপি গ্যাসের মত পণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সিগারেটে আরেক দফা দাম ও কর বাড়ানো হয়েছে।
মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির উপর প্রথমবারের মত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।
এনবিআরের মতে, শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই। অর্থ উপদেষ্টাও একই বলেছেন। তাদের দাবি হল- চাল, তেল, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর ছাড় দিয়েছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবং বাজারে সরবরাহ বাড়াতে।
তবে সরকারের এই পদক্ষেপের প্রতিফলন কমই দেখা গেছে মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে। নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে সামান্য কমলেও দুই অংকের মূল্যস্ফীতি নিয়েই ২০২৪ সাল শেষ করেছে বাংলাদেশ।
বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
সেই হিসাবে ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও পুরো বছরের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) গড় মূল্যস্ফীতি ঠিকই দুই অঙ্কের ঘরে রয়ে গেছে।
গেল বছর সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ; যা ২০২৩ সালে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ ছিল।
ওষুধ ও মোবাইলের টকটাইমে ভ্যাট ও শুল্ক-কর বাড়লে তার প্রভাব দেশের সর্বস্তরেই পড়ে বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “খাদ্য মূল্যস্ফীতি না বাড়লেও খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে। যা গত কয়েক মাস ধরে কমছে।”
বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত খাতেও মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। তবে খাদ্য খাতের মূল্যস্ফীতির হার এখনো ১৩ শতাংশের কাছাকাছি রয়ে গেছে।
খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
আর খাদ্য বহির্ভূত খাতে নভেম্বরের ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ থেকে কমে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়েছে ডিসেম্বরে।
এছাড়াও ৩০ লাখের ওপর বিক্রি হলে সকল পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত এবং টার্নওভার কর খাদ্যেও মূল্যস্ফীতি বাড়াবে, এমন শঙ্কায় ‘ভিন্ন পথেই হাঁটা যেত’ বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
“কর ফাঁকি রোধে ইউনিফিকেশন বা একক হারে ভ্যাটে যেতে হবে। মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ‘টাইমিংটা’ ঠিক হয়নি,” তার ভাষ্য।
খাত সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য কী
ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়টি ‘আইনসিদ্ধ’ হয়নি বলে দাবি করেছেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুক্তাদির।
তিনি বলেন, “ভ্যাট বাড়ানোর একটা নিয়ম আছে। বর্তমানে আমরা উৎপাদন থেকে পাইকারি পর্যায়ে যখন সরবরাহ করছি তখন ১৫ শতাংশ অলরেডি ভ্যাট দিচ্ছি। এরপর তারা যখন খুচরায় বিক্রি করে তার জন্য তাদের প্রফিট মার্জিন দিতে হয় ১৬ শতাংশ। ভ্যাট নিলে তাদের থেকে ১৫ শতাংশ নেওয়ার কথা ছিল।
“কিন্তু সরকার ২ লাখ প্রতিষ্ঠান এমন আছে তাদের থেকে নিতে পারে না। ফলে সরকার আমাদেরই বলেছে, এই মার্জিনের ওপর ২ দশমিক ৪০ টাকা ভ্যাট কেটে পরিশোধ করতে। আমরা তা অগ্রিম দিই। এখন আপনি যদি ধরেন ১৬ টাকার মধ্যে ৩ টাকা দিয়ে দেব তখন ভ্যাট দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।”
মুক্তাদির বলেন, “আর এ খাত ভালো আছে এটা ঠিক না। আমরা গত ৩০ বছরেও অনেক ওষুধের দাম বাড়াইনি। এর মধ্যে ডলারের মূল্য বেড়েছে। জ্বালানি খরচ বেড়েছে। বেতন বেড়েছে। সকল উপাদানের খরচ বেড়েছে। খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে কোনোভাবে টিকে থাকছি।
তবে ভ্যাট বাড়ায় ওষুধের দাম এখন বাড়বে কিনা, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।