দুয়ার খুলল বাণিজ্য মেলা: ২০২৫ সালের বর্ষপণ্য আসবাব
‘ফার্নিচার পণ্য’কে ২০২৫ সালের ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, “আমি বছরের সেরা উদ্যোক্তা নির্বাচনেরও আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে সবাই জানতে পারে পণ্যের উদ্যোক্তা কে।”
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার পূর্বাচলে এ মেলার ২৯তম আসরের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। পূর্বাচলের বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে এ নিয়ে চতুর্থবার বাণিজ্য মেলা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এ মেলার যৌথ আয়োজক।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “দেশের রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে সরকার নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে রপ্তানিতে অবদান ও সম্ভাবনার বিষয় বিবেচনায় পণ্য খাতকে যথাক্রমে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত’ ও ‘বিশেষ অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
“এছাড়া রপ্তানি প্রসার ও প্রণোদনামূলক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করতে প্রতিবছর একটি পণ্য খাতকে ‘বর্ষপণ্য’ বা 'প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণকে ঘোষিত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে উৎসাহিতকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এবার ‘ফার্নিচার পণ্য’কে ২০২৫ সালের ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।”
পণ্যের পাশাপাশি সেবা খাতে বিনিয়োগ এবং রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে আসার জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “দেশে উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রীকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী উৎপাদন ও রপ্তানিতে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। এই সংস্থা নতুন নতুন পণ্যকে রপ্তানিতে অন্তর্ভুক্তকরণ, পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং পণ্য বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করছে।
“এ ধরনের বিপণন প্রসারমূলক কার্যক্রমের ফলে ইতোমধ্যে আমাদের তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে নেতৃস্থানীয় অবস্থান তৈরি করেছে। বেকারত্ব কমানো, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন এবং দারিদ্র্য কমিয়ে আনার মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্য দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।”
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় পণ্যের মান উন্নয়নে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে আরও শক্তিশালী করার কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “রপ্তানি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক ও দ্রুততর সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিদ্যমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা সংক্রান্ত গ্যাপ নিরূপণের জন্য সার্ভে করা হচ্ছে। সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমাদের রপ্তানিকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।”
দেশে পণ্য প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় এ মেলায় এবার ৩৬২টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫১টিই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের স্টল-প্যাভিলিয়ন। আর বাকি ১১টি স্টল সাতটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।
দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিপণন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করছে বাংলাদেশ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা যখন প্রথম শুরু হয়েছিল, তখন প্রথম দিকে দুয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার।
“নামটা ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা’, তিনটি শব্দের সমন্বয়ে। কারো মনোযোগ ‘আন্তর্জাতিক’-এর দিকে, কারো ‘বাণিজ্য’র দিকে, আবার কারো ‘মেলা’র দিকে। আমার আকর্ষণ বরাবরই মেলার প্রতি।
“মেলা দেখতে ভালো লাগে। এটাই মেলার মূল আকর্ষণ। সবাই আনন্দ করতে আসে। অনেকে আগেই পরিকল্পনা করে যে মেলা থেকে কী কী জিনিস কেনা হবে। পরে জেনেছি, অনেক পরিবার সারা বছরের কিছু কেনাকাটার পরিকল্পনা বাণিজ্য মেলার জন্য তুলে রাখে। এটি আমার কাছে অবাক করা বিষয়। সারা বছরের পরিকল্পনা বাণিজ্য মেলায় কিনব... একটা আকর্ষণ আছে বাণিজ্য মেলার।”
মেলাকে ‘মস্ত বড় সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করে সরকারপ্রধান বলেন, “মানুষ যেহেতু আকৃষ্ট হয়, তার কাছে কথাগুলো তুলে ধরা, তার চিন্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া, এই সুযোগটা এই মেলা আমাদেরকে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য করি, টাকা-পয়সা রোজগার করি, ব্যবসা-বাণিজ্য করি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করি, দেশের উপকার হয়– সব কিছু ভালো কথা। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা হল মানুষের মন। মনের মধ্যে কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় সেটা। তার চিন্তার ভেতরে কী ঢুকিয়ে দিতে পারি, কী জিনিসটা সে গ্রহণ করে সেটা। এটা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ইউনূস বলেন, “এ দেশটা অপূর্ব সুযোগের দেশ। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি অসংখ্য মানুষ। ১৭ কোটি মানুষের দেশ, ছোট্ট একটা জায়গার ভেতরে। তার মধ্যে বেশিরভাগ হল টাটকা তাজা তরুণ। এরকম শক্তি খুব বেশি দেশের কপালে আসেনি। আমাদের এসেছে। যেটার কারণে বারবার জোর দিচ্ছি–এই তারুণ্যের শক্তিকে উন্মোচিত করার সুযোগ সৃষ্টি করার।”
ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখায় গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস মনে করেন, মানুষ মাত্রই উদ্যোক্তা, শ্রমিক নয়।
“শ্রমিকটা হল একটা বিপথে চলে যাওয়া। এটা মানুষের পথ নয়। মানুষের পথ হলো সৃষ্টি করা, নিজের মনের মধ্যে যা আছে তা সৃষ্টি করা, অন্যের হুকুমে সৃষ্টি করা নয়।
“এই মেলা আমাদের সৃষ্টির সুড়সুড়ি দেয়। এই মেলা একটা সুযোগ দেয়, একজনেরটা দেখে আরেকজনের মাথায় সুড়সুড়ি দেয়। এই সুযোগটা যেন আমরা গ্রহণ করতে পারি।”
তিনি বলেন, “আমার মনে মনে যে মেলার ছক, সেটা হল, এগুলো তো থাকবে, এর সঙ্গে আরও অনেক জিনিস থাকতে পারে। এখুনি যে করতে হবে তা নয়, তবে সেই চিন্তা আমরা করতে পারি। তরুণদের একাংশ বাণিজ্য মেলার একটি অংশে থাকবে। ওই অংশটা তাদেরই। ২৫ বছরের নিচে হতে হবে– এরকম কিছু শর্ত দিয়ে রাখতে হবে। তারা এখানে আসতে পারবে, দেখাতে পারবে কী করে তারা।
“আমরা যদি খুঁজি, অবাক কাণ্ড, অসংখ্য রকমের কাজ করছে এই তরুণরা। কিন্তু কোথাও স্বীকৃতি নেই। ঘরে বসে শাড়ি বিক্রি করছে, তার ক্রেতা বহুজায়গায়। গৃহিণী, বয়স্ক মহিলা, ৪-৫ ছেলেমেয়ের মা ব্যবসা করছে। কী করে রান্না করে খাওয়ায়, অর্ডারটা তিন দিন আগে দিতে হয়, কী কী চান ঠিক রান্না করে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। কোনো স্বীকৃতি নেই!”
এমন উদ্যোক্তাদের জন্য মেলার একটি অংশ বরাদ্দের পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “চমৎকার বুদ্ধি নিয়ে, দুনিয়ার সব কাজের ফাঁক দিয়ে, সে নিজে একটা ব্যবসা সৃষ্টি করে ফেলেছে। এটা দেখানো এই জন্য দরকার… ওই যে বললাম, সুড়সুড়ি। এটা দেখার পর প্রত্যেকের মাথায় সুড়সুড়ি আসবে। ‘আরে আমিও তো এর চেয়ে সুন্দরভাবে করতে পারি, আমিও করতে পারি।’
“মেলার উদ্দেশ্যই হল সুড়সুড়ি দেওয়া, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মাথার মধ্যে সুড়সুড়ি দেওয়া।”
ইউনূস বলেন, “তরুণদের একাংশের মধ্যে মেয়েদের একটা অংশ থাকবে, যাতে তারাই স্ফূর্তি করে দেখায় কী করছে তারা। কত রকমের কাজ তারা করছে। ছেলেদেরটাও দেখবে। ছেলেরা মেয়েদেরটা দেখবে। দেখে আরও বুদ্ধি বাড়বে। বুদ্ধিতে বুদ্ধিতে ঘষা দিলে আরও বুদ্ধি বাড়ে। কাজেই সুযোগ সৃষ্টি করা।”
বাণিজ্য মেলায় কারা অংশ নেবে, তা ঠিক করতে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা করার প্রস্তাব রাখেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “মেলার প্রস্তুতি সারা বছর ধরে চলবে। জেলায় জেলায়, উপজেলায় উপজেলায়, বাছাই করা হবে– কে ফাইনাল মেলায় জায়গা পাবে। কার বুদ্ধি সব চাইতে বেশি। কৃষিতে, শিল্পে, হস্তশিল্পে– যত রকমের জিনিস আছে। আইসিটি, কত রকমের ব্যবসা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা। ঘরে বসে সফটওয়্যার বিক্রি করছে।
“প্রতিযোগিতা হবে। প্রত্যেক উপজেলা থেকে যারা বিজয়ী হবে, তারা আসবে। তাদের সমস্ত খরচ সরকার বহন করবে। কারণ তারা আমাদের পথপ্রদর্শক। তারা জাতিকে পথপ্রদর্শন করবে, দুনিয়াকে পথপ্রদর্শন করবে। আন্তর্জাতিক তরুণরা দেখতে আসবে– বাংলাদেশের তরুণরা কী করছে। বুদ্ধি নিতে আসবে, শিখতে আসবে, জয়েন্ট ভেঞ্চার করতে আসবে।”
ইউনূস বলেন, “মেলার উদ্দেশ্য যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া, খাপে খাপে মিলিয়ে দেওয়া। আমরা সেরকমভাবে তরুণ-তরুণীদের করতে পারি, বয়স্কদের করতে পারি।
“একজন মানুষ কখনো রিটায়ার্ড করতে পারে না। মৃত্যু পর্যন্ত সচল, সজাগ, কর্মঠ। তার আগে সে থামে না। কিন্তু আমরা একটা বয়স নির্ধারণ করেছি। এত বছর হলে তুমি রিটায়ার্ড। জোর করে একজন মানুষকে অচল করে দেওয়া, বিকল করে দেওয়া। এই শব্দটাকে ডিকশনারি থেকে বের করে দিতে হবে।”
বয়স্কদের উদ্ভাবন দেখানোর জন্য মেলায় আলাদা জায়গা নির্ধারণেরও প্রস্তাব দেন প্রধান উপদেষ্টা।