হালখাতা: পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ঐতিহ্য রক্ষার ‘দায়’

আগের বছরের দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুন বছরে নতুন করে হিসাবের খাতা খোলার রেওয়াজই হচ্ছে হালখাতা; বৈশাখের প্রথম দিনের এ আয়োজনটির ঐতিহ্যে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা বৈচিত্র্য।
চারিদিকে প্রযুক্তির ছোঁয়া, যোগাযোগ পদ্ধতিতে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সজহলভ্য হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ সম্পর্কেও এসেছে ভিন্ন মাত্রা।
এ কারণে আগের দিনের হালখাতা উপলক্ষ্যে যে রঙিন কার্ড ছাপানো হত, তা এখন আর তেমন দেখা যায় না। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তায় জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুরনো হিসাবের তথ্য।
এ ধরনের নানা কারণে হালখাতার প্রচলন উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তারপরও হালখাতার ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের সোনা ব্যবসায়ীরা।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনে হালখাতার প্রচলন হয় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে; মোগল সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর। বাংলা নববর্ষে রাজার ভাণ্ডারে খাজনা প্রদানের দিনটি কালের বিবর্তনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হালখাতায় রূপ নেয়।
ফারসি শব্দ ‘হাল’ অর্থ নতুন। সে অর্থে পুরনো হিসাবনিকাশ চুকিয়ে নতুন খাতায় নাম লেখানোই হালখাতা।
লাল কাপড়ের মলাটে বাঁধাই করা সেই নতুন খাতাই ক্রেতা-বিক্রেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের পরম্পরা হিসেবে থেকে যায়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, লক্ষ্মীবাজার ও শাঁখারি বাজারের ব্যবসায়ীরা এবার দুই দিন, অর্থাৎ সোম ও মঙ্গলবার হালখাতা বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবেন।
খ্রিষ্ট্রীয় বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪ এপ্রিল হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। সরকারি হিসাবে তা সোমবার হওয়ায় তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সোমবারই বৈশাখের প্রথম দিন ধরে হালখাতা করবে।
অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের পঞ্জিকা হিসাবে এবার পহেলা বৈশাখ পড়েছে ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার।
সরকারি ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা হিসাবে বাংলা নববর্ষ একই দিনে পড়ে চার বছর পরপর। এ বছর তারিখ ভিন্ন হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যবসায়ী দুই দিনই হালখাতা করার কথা জানিয়েছেন।
অপেক্ষাকৃত ছোট দোকান বা প্রতিষ্ঠানগুলো হালখাতা করবে একদিন। তারপরও ‘পুরনো’ ক্রেতাদের জন্য দুই দিনই ‘আপ্যায়নের’ ব্যবস্থা রাখবেন তারা।
তাঁতিবাজার মূলত সোনার গহনা বেচাকেনার জন্য পরিচিত। ফলে হালখাতার রেশ এ বাজারেই বেশি চোখে পড়ে।
একসময় হালখাতার আনন্দের গভীরতাকে বোঝাতে মুসলিমদের ঈদের সঙ্গে তুলনা করেন তাঁতিবাজারে ৪৫ বছর ধরে সোনার ব্যবসা করা মৃণাল কান্তি সরকার।
এনজি গোল্ড জুয়েলার্সের এ কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘হালখাতার দিন আইলেই মনে আনন্দ ছুইটা যাইত। মুসলমানরা যেমন ঈদের আনন্দে খুশি হইত, আমাগো খুশি আছিল তেমন।
“কত লোক আইত, আমরা যাইতাম অন্য দোকানে। সব কাস্টমার টাকা নিয়া আইত। যাগো কাছে টাকা পাইতাম না, তাদেরও দাওয়াত দিতাম।’’
তিনি বলেন, “এখন আর সেদিন নাই। এখন হিসাব তো দুইটা। একটা সরকারি ও আরেকটা পঞ্জিকা। আমরা ব্যবসায়ীরা পঞ্জিকা অনুযায়ী হালখাতা করুম।’’
আগে মুড়কি, নাড়ু, জিলাপি, বাতাসা, মণ্ডা, মিঠাই, মিষ্টান্ন বা ভাত-তরকারির ব্যবস্থা থাকত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এহন আর সে দিন নাই। হালখাতা আছে শুধু নামে। মানুষে মানুষে ভাগাভাগি হয়ে গেছে।
“নতুন নতুন দোকান হইছে, দূরের কাস্টমারও কমছে; বাকির ব্যবসাও কমছে। যা বাকি যায়, খুবই পরিচিতজনরা নেয়। তাই হালখাতায় খুব একটা লাভ হয় না।’’
বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সোম ও মঙ্গলবার দুই দিনই হালখাতার আয়োজন করবেন এ বাজারের কে সি পাল জুয়েলার্সের উদ্যোক্তা কমলেশ চন্দ্র পাল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘দুই দিনই করব। কোন কাস্টমার কবে আসে, তার তো ঠিক নেই।’’
এবারের হালখাতার আয়োজন ছোট পরিসরে করবে তাঁতিবাজারের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কাইউম জুয়েলার্স।
রোববার সোনার ভরি এক লাখ ৬৩ হাজার টাকা হওয়ার তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রবিন বলেন, ‘‘দাম এত হইলে কে কিনব। এত টাকা দিয়ে কতজন গয়না বানাতে পারবে? গলারটা বানাইলে হাতেরটা হবে না।’’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘আগে মানুষ শখ কইরা হাতের আংটি উপহার দিত। জন্মদিন বা জন্মের সময়ে বাচ্চাদের হাতের আংটি বা ছোটো করে গলার চেইন গিফট দিত। এখন আংটি বানাতেই ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগবে। একটা চেইন বানাতে আরও বেশি লাগে।’’
রবিন বলেন, ‘‘হালখাতার দিনে কাস্টমার ডাকলে তো খরচ হবে অনেক। এত টাকার ব্যবসা নাই এখন। তাই ডাকাডাকি নাই। যারা খুব পরিচিত তাদের ফোন করেছি। যারা আসবে, তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হবে।’’
শুধু ঐতিহ্য ও ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেও হালখাতা ধরে রাখার কথা বলেছেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী।
রুহি জুয়েলার্সের ব্যবস্থাপক জয় সেন বলেন, “হালখাতার খরচই ওঠে না। এমনিতে সোনার বাজারে তো আগুন দাম।
“অন্য ব্যবসায়ীরা করবে, আমরা করব না, তা হয় না। এজন্য সামান্য হলেও আয়োজন থাকবে, ঐতিহ্য ধরে রাখতে যতটুকু করা যায়।”
ক্রেতার কাছে পাওনার পরিমাণ আগের চেয়ে কম থাকে জানিয়ে পুরান ঢাকার রিমিতা জুয়েলার্সের উদ্যোক্তা কার্তিক নন্দী বলেন, ‘‘আয়োজন মোটামুটি থাকবে। ঘটা করে কাউকে বলা হয় নাই, যারা আসবে তাদের জন্য মিষ্টান্ন থাকবে।’’
অর্পিতা শাখারির ব্যবস্থাপক রমেন্দ্র নাথ সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘দোকান তো সাঁজাতে হবে। দেখবেন দুই দিনই হালখাতা করবে সবাই। কাস্টমারকে তো আর পঞ্জিকা বোঝানো যাবে না; সরকারি তারিখও মানতে হবে।’’
প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসাব রাখার জন্য নতুন টালি খাতা খোলেন ব্যবসায়ীরা। এখন সেই টালি খাতার স্থান নিয়েছে বিভিন্ন প্রকারের সফটওয়্যার। এতে কাগুজে লাল রঙের খাতার ব্যবহার কমছে দিন দিন।
বাংলা বাজারে নিজস্ব কারখানায় লাল মলাটের বিভিন্ন ধরনের খাতা তৈরি ও সরবরাহ করেন লিয়াকত আলী। নববর্ষ উপলক্ষ্যে শাঁখারি বাজারে সড়কের পাশে অস্থায়ী দোকান বসিয়েছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বেচাকেনা ভালোই। গত বছর বেশি বিক্রি হয়েছিল। কম্পিউটার আইছে তো, এজন্য খাতা একটু কমই চলে।’’
অস্থায়ী দোকানে আরও দুদিন খাতা বিক্রি করবেন আরেক ব্যবসায়ী আরশাদ আলী। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত দোকান চালু রাখব। তারপর কারখানায় নিয়ে যাব।”