প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন ঘোড়াঘাট সুরা মসজিদ সংস্কারের দাবি

দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার প্রাচীনতম স্থাপত্য নিদর্শন ঐতিহাসিক ‘সুরা মসজিদ’। ৫০০ বছরের পুরাতন এই মসজিদে এখনও মুসল্লিরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। রমজানে তারাবির নামাজও আদায় করা হয়। তবে দীর্ঘদিন এর সংস্কার না হওয়ায় মসজিদটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে মসজিদ কমিটি। ফলে মসজিদটির সংস্কার করার কেউ নেই।
সম্প্রতি বাসসের সাথে আলাপকালে মসজিদ কমিটির সভাপতি, মসজিদের ইমাম ও এলাকাবাসী ঐতিহাসিক এ মসজিদটির দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, দূর দূরান্ত থেকে এই মসজিদে যারা নামাজ পড়তে আসেন তাদের অনুদানেই মসজিদটির সংস্কার করা সম্ভব। তারা এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে ঘোড়াঘাট-হিলি পাকা রাস্তার পাশে চোরগাছা মৌজায় অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্যের অনিন্দ্য নিদর্শন সুরা মসজিদ। ৫০০ বছর আগের দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের নির্মাণ কারুকার্য এক নজর দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি দর্শক ও পর্যটকেরা। স্থানীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে সারা বছর।
সুরা মসজিদের নাম নিয়ে নানা জনের নানা মত রয়েছে। অনেকেই এ মসজিদকে ‘সৌর মসজিদ’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। আবার কেউ বলেন ‘সুরা মসজিদ’। আবার অনেকের কাছে ‘সুজা মসজিদ’ নামে পরিচিত। সম্রাট শাহ সুজা’র নাম অনুসারে তারা একে সুজা মসজিদ বলে অভিহিত করেন।
স্থানীয়দের মতে, ‘সুর’ শব্দের অর্থ ‘অপদেবতা’ বা ‘জিন’। জনশ্রুতি আছে, শত শত বছর আগে জিনেরা এক রাতে মসজিদটি নির্মাণ করেন।
আবার মসজিদটির কারুকার্য ও নির্মাণশৈলী দেখে কেউ কেউ ধারণা করেন, ১৬ শতকের সুলতানি আমলে সুলতান হোসেন শাহের শাসন আমলে এটি নির্মাণ করা হয়। এ মসজিদকে আসমানি বা গায়েবি অর্থাৎ লোকচক্ষুর আড়ালে তৈরি হওয়া মসজিদ বলেও দাবি করা হয়। আবার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, মোগল শাসন আমলে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তাই তারা একে ‘শাহ সুজা মসজিদ’ নামে ডাকেন।
মসজিদে সংরক্ষিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শাহ সুজার ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগেই এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। যেহেতু এই মসজিদটিতে কোন শিলালিপি নেই। তাই গঠনশৈলীর উপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য নির্মাণকাল বের করা হয়েছে। স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণকালের কলা কৌশল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা হয়, সুলতান হোসেন শাহের আমলের নিদর্শন এটি।
এই মসজিদটির বাইরের দিকের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিম ২৬ ফুট। ৪ ফুট উঁচু মজবুত প্লাটফর্মের ওপর মসজিদের অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এর প্রধান কক্ষের আয়তন ভেতরে ১৬ দশমিক ১৬ ফুট। প্রধান কক্ষের সাথে যুক্ত আছে ৬ ফুট প্রশস্ত রাস্তা। পুরো মসজিদের দেয়ালে অসংখ্য খোপকাটা মৌলিক টেরাকোটার অলংকরণ, যা এর ইমারতের বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
সুলতানি আমলের বিরল নিদর্শন ও স্থাপত্য কীর্তি সুরা মসজিদ প্রধানত দু'টি ভাগে বিভক্ত। নামাজের কক্ষ ও বারান্দা। মসজিদের উপরে বর্গাকার ও গম্বুজ বিশিষ্ট নামাজ কক্ষ এবং ছোট ৩ টি গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বারান্দা রয়েছে। নামাজের কক্ষটির দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৮৪ মিটার এবং প্রস্থও ৭ দশমিক ৮৪ মিটার। বারান্দার মাপ ৪ দশমিক ৮৪ মিটার লম্বা ও ২ দশমিক ১২ মিটার চওড়া। চুন সুরকির সাহায্যে ছোট আকৃতির ইট দিয়ে নির্মিত মসজিদের দেয়াল ১ দশমিক ৮০ মিটার প্রশস্ত। নামাজ কক্ষের ৪ কোণে ৪টি ও বারান্দায় দু'টি কালো পাথরের মিনার আছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব দিকে ৩টি ও উত্তর দক্ষিণ দিকে একটি খিলানকৃত প্রবেশ পথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে কেবলা দেয়ালে ৩টি সুন্দরভাবে অলংকৃত পাথরের তৈরি অবতল মেহরাব আছে। মসজিদে ইটের সাথে পাথরের ব্যবহার দেওয়ালের মাঝে মাঝে পাথর স্তম্ভ ও ইটের গাঁথুনি নান্দনিক সৌন্দর্য তৈরি করেছে। এছাড়া প্রত্যেক দরজার নিচে চৌকাঠ রয়েছে। সেগুলো পাথরের তৈরি। পূর্ব পাশে মসজিদে প্রবেশের সিঁড়ি। এখানকার কালো বেলে পাথর বাংলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজমহল থেকে আনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে ।
প্রতিদিন শত শত দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী ও পর্যটক মসজিদটি দেখার জন্য আসেন। অনেকে আসেন এখানে মানত করা গরু-খাসি কোরবানি দিয়ে রান্না করে স্থানীয় লোকজনকে খাওয়ানোর জন্য। যাতে তাদের মনের আশা পূর্ণ হয়।
মসজিদের খাদেম মো. সাদিক আলী ফকির বাসসকে বলেন, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে বহিরাগত লোকজন ও মুসল্লিদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজিদে ভিড় বেড়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মনে করেন, এই মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে নামাজ আদায় করতে পারলে এবং ইফতারিতে অংশগ্রহণ করলে অনেক সওয়াব পাওয়া যাবে। তাদের এই প্রত্যাশা থেকে পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিন ইফতারে বিপুল সংখ্যক মুসল্লির সমাগম হয়।
তিনি বলেন, মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ইফতারির আয়োজন করার প্রয়োজন হয় না। আগত বিভিন্ন মুসল্লিরা ইফতারি নিয়ে আসেন। যা দিয়ে নামাজে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের ভালোভাবে ইফতারি হয়ে যায়। একই ভাবে তারাবির নামাজে মুসল্লিদের সমাগম বেশি হয়। সব মিলিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে পবিত্র রমজান মাসের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ ইফতারি ও তারাবির নামাজ আদায় করা হয়।
স্থানীয় লোকজন ও মুসল্লিদের মতে, ঐতিহাসিক সুরা মসজিদটি সংস্কার করে মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে পারলে, দর্শনার্থীর সংখ্যা আরো বাড়বে। তবে এজন্য সরকারি পদক্ষেপ বিশেষভাবে জরুরি। এলাকাবাসীর দাবি, এর আগে অনেক জেলা প্রশাসক এই ঐতিহাসিক মসজিদ পরিদর্শন করে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
মসজিদের ইমাম মওলানা মো. ইনামুল হক বলেন, ‘আমি এই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াই। দিনাজপুর জেলার প্রাচীন এই মসজিদটি প্রায় পাঁচ’শ বছর আগে নির্মিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা মসজিদটি দেখার জন্য আসেন। দর্শনার্থীরা কেউ নামাজ আদায়ের জন্য আবার কেউ মানত শোধ করার জন্য আসেন। তাই এই মসজিদটি অক্ষত রাখতে এর সংস্কার জরুরি।’
সূরা মসজিদের সভাপতি আলহাজ্ব মো. সেকেন্দার আলী বলেন, ‘এটা দিনাজপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। ঐতিহাসিক নিদর্শন এই মসজিদটির মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে যুগোপযোগী সংস্কার করে ঐতিহাসিক নিদর্শনটি ধরে রাখা জরুরি। সংস্কারের মাধ্যমে মসজিদের চারপাশে দেয়াল নির্মাণ ও মূল ফটক স্থাপন করলে মসজিদটির সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা দুইই বৃদ্ধি পাবে। তিনি এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।’