বৃহস্পতিবার ০৩ এপ্রিল ২০২৫, চৈত্র ১৯ ১৪৩১, ০৪ শাওয়াল ১৪৪৬

সংস্কৃতি

ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অনিন্দ্য নিদর্শন বাঘা শাহী জামে মসজিদ

 প্রকাশিত: ১১:৩১, ২৫ মার্চ ২০২৫

ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অনিন্দ্য নিদর্শন বাঘা শাহী জামে মসজিদ

ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অনিন্দ্য নিদর্শন জেলার বাঘা শাহী জামে মসজিদ। ৫০০ বছরের ইহিতাস ও ঐতিহ্য বহনকারী মসজিদটির নির্মাণশৈলী যেকোনো দর্শনার্থীকেই মুগ্ধ করে। 

রাজশাহী মহানগর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলা সদরে অবস্থিত মসজিদটি পর্যটকদের জন্যও এক আকর্ষণীয়  স্থান। 

রাজশাহী জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫২৩-১৫২৪ সালে (৯৩০ হিজরি) হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নুসরাত শাহ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদের সংস্কার করা হয় এবং মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙ্গে গেলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদে ১৮৯৭ সালে নতুন করে ছাদ দেয়া হয়। মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত। 

মসজিদটির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য 

মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সমভুমি থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর পাশের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে । আর ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে ৪টি মেহরাব রয়েছে যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত। দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদটির গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে। ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। বাঘা মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। এর দেয়াল ২.২২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে সর্বমোট ১০টি গম্বুজ, ৪টি মিনার (যার শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির) এবং ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই মসজিদটি চারদিক হতে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং প্রাচীরের দু’দিকে দু’টি প্রবেশদ্বার। 

এই মসজিদের বিশেষত্ব হলো সম্পূর্ণ মসজিদটি টেরাকোটার কারুকাজ। মসজিদটির গাঁথুনি চুন এবং সুরকি দিয়ে। মসজিদের ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে সুন্দর মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। পোড়ামাটির নকশায় আমগাছ, শাপলা ফুল, লতাপাতাসহ ফার্সি খোদাই শিল্পে ব্যবহৃত হাজার রকম কারুকাজ। মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তর পাশেই রয়েছে হজরত শাহদৌলা ও তার পাঁচ সঙ্গীর মাজার। 

মসজিদের পাশেই বিশাল দিঘি। এই দিঘির পাশ দিয়ে চলাফেরার জন্য সরু রাস্তা। সুবিশাল দিঘির সামনে বসলে যে কারো মন জুড়িয়ে যাবে। 

বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহর পুত্র নাসিরউদ্দীন নুসরত শাহ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনেই  দিঘিটি খনন করেন। শাহী মসজিদ সংলগ্ন এ দিঘিটি ৫২ বিঘা জমির ওপর প্রবাহিত।

দিঘির চারপাশে রয়েছে সারিবদ্ধ নারিকেল গাছ। প্রতিবছর শীতের সময় এ দিঘিতে অসংখ্য অতিথি পাখির কলতানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে দিঘিটির চারটি বাঁধানো পাড় নির্মাণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া এ মসজিদ সংলগ্ন জহর খাকী পীরের মাজার রয়েছে। মূল মাজারের উত্তর পাশে রয়েছে তার কবর। 

১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশে খনন কাজের ফলে ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মেলে। এই পুকুরটি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সাথে যুক্ত ছিল। তিন দিক থেকে বাঁধানো সিঁড়ির পুকুরের ভেতরে নেমে গেছে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে প্রচুর পোড়ামাটির ফলক। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত একটি বিশেষ নামাজের কক্ষ আছে। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে তিন দিন পর্যন্ত ‘বাঘা মেলা’র আয়োজন করা হয়। এ মেলাটি ৫০০ বছরের ঐতিহ্য। এই মেলায় বাঘা উপজেলার মানুষসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও পাশের জেলার মানুষ অংশ নেয়। 

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রাচীন ঐতিহাসিক এ মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন শত শত মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের আনাগোনা থাকে। কেউ কেউ আবার পরিবার নিয়ে এসে মসজিদের পাশেই রান্না করে খাওয়া দাওয়া করেন। অনেকে আবার হাঁস, মুরগি, ছাগল টাকাসহ বিভিন্ন জিনিস মানত করেন মনের আশা পূরণের জন্য। 

পুরুষ দর্শনার্থীদের অধিকাংশই এ মসজিদে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে যান। পবিত্র রমজানে এলাকাবাসী এ মসজিদে জুম্মা ও তারাবিহ নামায আদায়  করেন। আল্লাহর দরবারে মনের আশা পূরণের জন্য দোয়া করেন। 

দর্শনার্থী আব্দুল্লাহ বাসসকে বলেন, ‘মসজিদটির অনেক নাম শুনেছি। তাই দেখতে আসা। খুব ভালো লেগেছে। নামায আদায় করেছি।’ 

স্থানীয় এক বাসিন্দা বাসসকে বলেন, এ মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই মানুষ আসে। অনেকেই নামায আদায় করেন। এটি আমাদের গর্বের মসজিদ। এছাড়াও মসজিদটি ৫০ টাকার পুরাতন নোট স্থান পেয়েছে। এটিও আমাদের জন্য অনেক গৌরবের।