মোগল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন শাহ সুজা মসজিদের সংস্কার প্রয়োজন

কুমিল্লা জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে মোগল স্থাপত্য নিদর্শন ৩৬৭ বছরের পুরাতন শাহ সুজা মসজিদ। জেলার সদর উপজেলার মোগলটুলীতে গোমতি নদীর (বর্তমানে পুরাতন গোমতি) কোল ঘেঁষে অবস্থিত এ মসজিদটি।
দেশের দুর দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসেন মসজিদটিতে নামাজ পড়তে। বিশেষ করে জুম্মার নামাজকে কেন্দ্র করে মুসল্লিদের বড় মিলনমেলায় পরিণত হয় এই মসজিদ।
কয়েক’শ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী এ মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রায়ই বিপাকে পড়তে হয় আগত মুসল্লিদের।
শাহ সুজা মসজিদটি এই উপমহাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তিগুলোর অন্যতম। আয়তনের দিক দিয়ে খুব বেশি বড় না হলেও এর কৃষ্টি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সার্বিক অবয়ব আভিজাত্যের এক অনন্য নিদর্শন। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় মসজিদের বিভিন্ন অংশের ছাদ খসে পড়ছে। বৃষ্টি হলেই নানা জায়গায় পানি পড়ে। খসে পড়ছে চুন সুরকির দেয়াল। ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় শিগগিরই মসজিদের সংস্কার প্রয়োজন।
কুমিল্লা জেলার ইতিহাস পাঠ থেকে জানা যায়, প্রাচীন ও মোগল আমলের অসংখ্য মসজিদ কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করেছে। বর্তমান কুমিল্লা অর্থাৎ পূর্বতন ত্রিপুরা জেলায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে মুসলমানদের আগমন ঘটে। চতুর্দশ শতাব্দীতে এ জেলায় তুর্কি মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই এ জেলায় ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয়। সুলতানি আমল, পাঠান ও বার ভূঁইয়াদের আমল এবং মোগল আমল ছিল এ জেলায় মুসলিম শাসনামল।
মুসলিম শাসনামলের মধ্যে কুমিল্লায় মোগল আমলে নির্মিত মসজিদ ও স্থাপত্যকীর্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব স্থাপত্যকীর্তির মধ্যে অন্যতম কুমিল্লার শাহ সুজা মসজিদ।
সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় ছেলে শাহ সুজা ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন । ওই সময়ে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে গোমতী নদীর কোলঘেঁষে গাংচর-মোগলটুলি এলাকায় নির্মিত হয় শাহ সুজা মসজিদ। মুসলিম স্থাপত্যের মধ্যে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট শাহ সুজা মসজিদ ৩৬৭ বছরের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন।
শাহ সুজা মসজিদের বাইরের আয়তাকার দৈর্ঘ্য ১৭ দশমিক ৬৮ মিটার, প্রস্থ ৮ দশমিক ৫৩ মিটার। প্রাচীরগুলো ১ দশমিক ৭৫ মিটার পুরু। মসজিদের চার কোণে ৪টি অষ্টকোণাকার বুরুজ রয়েছে। এগুলো কার্নিশের বেশ ওপরে ওঠে গেছে ও এর শীর্ষে রয়েছে ছোট গম্বুজ। মসজিদের পূর্ব প্রাচীরে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণ প্রাচীরে একটি করে খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ রয়েছে। প্রধান প্রবেশ পথটি অপেক্ষাকৃত বড় ও একে অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রবেশ পথগুলোর উভয় পাশে ও ওপরে প্যানেল নকশা অলংকৃত। কিবলা প্রাচীরে রয়েছে তিনটি মিহরাব, কেন্দ্রীয়টি অপেক্ষাকৃত বড় ও অধিক আকর্ষণীয়। এটি ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশায় শোভিত। দুই পার্শ্বে খিলান দিয়ে মসজিদের অভ্যন্তর তিন ভাগে বিভক্ত। মধ্যের অংশটি বাইরের দিকে পূর্ব ও পশ্চিমে কিছুটা উদ্গত করে নির্মিত। এ অংশের চার কোণে চারটি সরু মিনার কার্নিশের ওপরে উঠেছে। অষ্টকোণাকার ড্রামের ওপর নির্মিত তিনটি গোলাকার গম্বুজ দিয়ে মসজিদের ছাদ ঢাকা। মধ্যেরটি অপেক্ষাকৃত বড়। গম্বুজগুলোর শীর্ষদেশ পদ্মনকশা ও কলস চূড়া দিয়ে শোভিত। মসজিদের কার্নিশের নিচের অংশ মারলোন নকশায় অলঙ্কৃত।
বিভিন্ন সময়ে মসজিদটির সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। মসজিদের একটি শিলালিপি পাঠ থেকে জানা যায়, ১৮৮২ সালে হাজী ইমামউদ্দিন ৭ দশমিক ৩২ মিটার প্রস্থের সমতল ছাদবিশিষ্ট বারান্দাটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মসজিদটি আরও সম্প্রসারিত ও দুই পার্শ্বে মিনার নির্মাণ করা হয়।
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার শাকপুর থেকে আসা মুসল্লি ওমর ফারুক জানান, জেলার প্রাচীন এ মসজিদটিতে শুক্রবার নামাজ পরার চেষ্টা করি। এ মসজিদে নামাজ পড়লে একটা মানসিক প্রশান্তি অনুভব হয়।
নগরীর মুরাদপুর থেকে আসা আবু কাউছার নামে আরেক মুসল্লি বলেন, শুক্রবারে ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে নামাজ পড়তে অনেক মুসল্লি আসেন। তাই স্থান সংকুলান হয় না। মূল কাঠামো ঠিক রেখে এ মসজিদের পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন।
চাঁদপুর জেলার হাইচর থেকে আসা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, একটি বিশেষ কাজে কুমিল্লায় এসেছি। আসার পর এ মসজিদে নামাজ পড়ার ইচ্ছে হলো। নামাজ আদায় করলাম, মসজিদের ভিতরে একটা শীতল অনুভূত হয়। এখানে নামাজ পড়ে ইতিহাস ঐতিহ্যর সাক্ষী হলাম। মসজিদের কারুকাজ দেখে অনেক ভালো লাগলো।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে এই মসজিদে অনেক মুসল্লি হয়। বিশেষ করে শুক্রবার, শবেবরাত, শবেকদরসহ বিশেষ দিনগুলোতে এখানে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। মসজিদটির দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম দর্শনার্থী ও মুসল্লিদের মুগ্ধ করে। এ মসজিদটি কুমিল্লা তথা মোগলটুলি এলাকাকে আলাদা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী মোঃ শাফায়েতুল ইসলাম ভূইয়া শরীফ বাসসকে বলেন, শাহ সুজা মসজিদ একটি ঐতিহ্য নাম, একটি প্রাচীন স্থাপত্য। শুধু কুমিল্লা নয়, সারা দেশের মধ্যে এটি একটি নান্দনিক মসজিদ। কালের সাক্ষী হয়ে কুমিল্লাকে সমৃদ্ধ করেছে দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি।
শাহ সুজা মসজিদের খতিব ও ইমাম মাওলানা মুফতি খিজির আহমদ কাশেমী বাসসকে বলেন, ‘শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখলেও মসজিদটির রয়েছে নানা সমস্যা। এ মসজিদটির ছাদ ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির সময় পানি পড়ে। মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয় না। জুম্মাবারসহ বিশেষ ধর্মীয় দিনে সড়ক ও ছাদে মিলে প্রায় ১৬ থেকে ১৭শ মুসল্লি নামাজ পড়ে। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় হওয়ায় আমরা কোন কাজ করতে পারছিনা। মসজিদটির জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। আমরা মূল কাঠামো বাদ দিয়ে পাশে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি এতে মুসল্লিদের স্থান সংকুলানসহ এ মসজিদের এতিমখানার পরিধিও বাড়বে।’
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কুমিল্লা শাখার উপ-পরিচালক আশেকুর রহমান বলেন, কালের সাক্ষী শাহ সুজা জামে মসজিদ। এ মসজিদে আমরা একটি মক্তবের ব্যবস্থা করে দিব।
তবে মসজিদটির ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় মূল কাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার প্রয়োজন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এ বিষয়ে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।