টিউলিপের বক্তব্য জানতে ঢাকার দুই ঠিকানায় তিনবার দুদকের নোটিস, চিঠি ফেরত

ঢাকার পূর্বাচলে প্লট ও রূপপুর প্রকল্পে ‘অনিয়মের’ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিককে তিন দফা নোটিস দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক); তবে সাড়া মেলেনি।
টিউলিপের ঢাকার দুটি ঠিকানায় মাস দুয়েকের মধ্যে পাঠানো এসব নোটিসের ‘রেজিস্ট্রি’ চিঠি প্রতিবারই কেউ গ্রহণ না করায় ফেরত আসার তথ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিয়েছেন তদন্ত সংস্থা দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
নোটিসের চিঠি পাঠানোর ক্ষেত্রে দুদক টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং আয়কর নথিতে দেওয়া ঢাকার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করেছে।
অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো তিনটি নোটিস গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে পাঠানো হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসবাসরত টিউলিপ বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং আয়কর নথিতে স্থায়ী হিসেবে ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়ির ঠিকানা দিয়েছেন। বর্তমান হিসেবে দেওয়া রয়েছে গুলশানের ৭১ নম্বর সড়কের একটি বাসার ঠিকানা।
দুদক অনুসন্ধান শুরুর পর তিন দফা নোটিস পাঠানোর কথা বললেও লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক এবং তার আইনজীবী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করার অভিযোগ করে আসছেন। একাধিকবার এ নিয়ে তাদের তরফে বক্তব্য এসেছে।
তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে টিউলিপ উল্টো দুদকের বিরুদ্ধে ভুয়া প্রচার চালিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন।
তিন দফায় নোটিস পাঠানো এবং সেগুলোর ‘ফেরত আসা’ বিষয়ক প্রশ্নে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টিউলিপ নির্দোষ হলে কেন পদত্যাগ করলেন?
“কেন তিনি তার আইনজীবীদের দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন? দুদক তার আইনজীবীকে ইমেইলের মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছে, যেন বাংলাদেশে এই মামলার আইনি লড়াইয়ে অংশ নেন।‘’
টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীকে তার ’সম্মানীর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যা পুরো ঘটনার পেছনে জালিয়াতি বা সাজানো কাহিনীর ইঙ্গিত দেয়। তবে দুদক কেবল নথিপত্র ও বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতেই কাজ পরিচালনা করে। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটি অভিযোগ যুক্তরাজ্যসহ যেকোনো আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব।
”কিয়ার স্টারমার (যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী) এবং তার দল (লেবার পার্টি) একজন এমপিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন– যিনি গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে জড়িত। বিষয়টি তারা নিন্দাও করছেন না, যা দেখে আমি লজ্জিত ও বিস্মিত।
‘‘মিস সিদ্দিক যখন ‘দুর্নীতি বিরোধী মন্ত্রী’ হিসেবে পদত্যাগ করেন, তখন প্রধানমন্ত্রী তাকে ‘নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে আপোষহীন’ বলে তুলে ধরেন। অথচ এই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই কতটা অবিবেচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা প্রশ্নের মুখে ফেলে।
দুদক প্রধান বলেন, ‘‘আরও অভিযোগ রয়েছে, টিউলিপ একটি ফ্ল্যাট ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার রাজনৈতিক প্রভাবেই ওই ফ্ল্যাট ইস্টার্ন হাউজিংয়ের নামে অবৈধভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। যদি কোম্পানিটি ব্যক্তিগত অনুদান হিসেবে ফ্ল্যাটটি দিত, তবে তা দুদকের আওতায় পড়ত না। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানির নামে প্রতারণার মাধ্যমে জমি হস্তান্তর হয়েছে–এটি যথেষ্ট প্রমাণ করে যে তার প্রভাব খাটানো হয়েছে।
”এই লেনদেনের সঙ্গে জালিয়াতি এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগও রয়েছে। কোম্পানিটি বারবার টাকা পরিশোধের কথা মনে করালেও তিনি অর্থ দেননি, তবুও জমির মালিকানা পেয়েছেন।’’
ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার আওতায় এমন অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে, যোগ করেন দুদক চেয়ারম্যান মোমেন।
প্রথম নোটিস পূর্বাচলের প্লটে ’অনিয়ম’ নিয়ে
বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ‘দুর্নীতি’ এবং লন্ডনে ‘উপহারের’ ফ্ল্যাট কাণ্ডের খবরে আলোচনায় আসা টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদে দুদক প্রথম নোটিস দেয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি।
রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলে প্লট পেতে ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে এ নোটিস দেওয়া হয়েছিল।
নোটিসে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ’ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে’ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ’যোগসাজশে’ নিজ নামে ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর রোড হতে ১০ কাঠা করে মোট ৬০ কাঠার ছয়টি প্লট বরাদ্দের অভিযোগ রয়েছে।
সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বক্তব্য রেকর্ড করে পর্যালোচনা করা ’একান্ত প্রয়োজন’ বলে তুলে ধরে নোটিসে ২ মার্চ টিউলিপকে দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়।
“নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানে ব্যর্থ হলে, কোনো বক্তব্য নেই মর্মে গণ্য করা হবে,” নোটিসে বলা হয়।
এর পর ৪ মার্চ দ্বিতীয় নোটিসে প্লট বরাদ্দের অভিযোগের মামলার বিষয়ে বক্তব্য দিতে ৬ মার্চ দুদকে হাজির হতে 'বিশেষভাবে অনুরোধ' করা হয়। সেদিনও টিউলিপের কোনো সাড়া পাননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক এস. এম. রাশেদুল হাসান।
অনুসন্ধান শেষে ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে ‘অনিয়মের’ অভিযোগে ছয়টি আলাদা মামলা করা হয়। এ নিয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল দুদক।
অপরদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নামে ’প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা লোপাটের’ আরেকটি অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বক্তব্য জানতে এ মাসের ৬ তারিখে আরেকটি চিঠি পাঠায় দুদক।
চার দিন সময় দিয়ে রাশিয়ার অর্থায়নে এ প্রকল্প শুরু করা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপকে ১০ এপ্রিল কমিশনে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়। এবারও সাড়া পাননি তদন্ত কর্মকর্তা।
তবে এ অভিযোগে এখনও কোনো মামলা হয়নি।
ছাত্র-জনতার তুমুল গণ আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। তিন দিন পর দায়িত্ব নেয় মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকে শেখ হাসিনাসহ শেখ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের খবর সামনে আসছে। তদন্ত শুরু হয়েছে অনেকগুলোর।
এ ধারাবাহিকতায় পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে দুদকের মামলায় ঢাকার একটি আদালত গত ১৩ এপ্রিল টিউলিপসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
সেই তালিকায় শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর নামও রয়েছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিন লন্ডনে নিজের বাড়ির বাইরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ বলেন, তিনি ভুল কিছু করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ কোথাও নেই।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের শিকার।”
বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি দাবি করে সেদিনও তিনি বলেন, তাকে ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ শিকার হতে হচ্ছে।
পদত্যাগ করা সিটি মিনিস্টার টিউলিপ বলেন, “এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার নিয়ে মন্তব্য করে আমি এগুলোকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তারা আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা করছে।”
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির দিন রাতে তার আইনজীবী পল থুয়েট এক বিবৃতিতে দাবি করেন, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে দুদকের আনা অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’।
প্লট দুর্নীতির মামলায় পরোয়ানা জারি নিয়ে আলোচনার মধ্যে এর তিন দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল টিউলিপের বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি মামলা করেছে দুদক।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করিয়ে দিয়ে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে সেখানে।
শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ড দামের একটি ফ্ল্যাট ‘উপহার’ পাওয়ার খবর নিয়ে সমালোচনার মধ্যে গত জানুয়ারিতে সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেন টিউলিপ সিদ্দিক।
টিউলিপের ‘হয়রানির’ অভিযোগের জবাব দিতে পরে নিজেই ৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে দুদকের চেয়ারম্যান আবদুল মোমেন দাবি করেন, টিউলিপ সিদ্দিককে দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের মামলায় আসামি করা হয়েছে।
“আসামিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং তাদেরকে আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের জবাব দিতে হবে।”