হেলিকপ্টার থেকে গুলি প্রসঙ্গে যা আছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে

জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের ভয়ভীতি দেখাতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালক বলছেন, র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তবে তারা নিশ্চিত করতে পারেননি যে, র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল কি না।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা এই প্রতিবেদন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সহজবোধ্যভাবে বোঝার সুযোগ করে দিতে অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর সম্পাদকীয় বিভাগ ইংরেজি থেকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ করেছে। বাংলায় অনূদিত সেই প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের কাছে সংবাদ আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে সেই প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্নস্থানে এবং পাশ্ববর্তী গাজীপুরে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। তখন হেলিকপ্টারের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আলোচিত সেই হেলিকপ্টারের ব্যবহার নিয়ে তথ্যানুসন্ধান করেছে ওএইচসিএইচআর।
বিভিন্ন ইউনিটের হেলিকপ্টার নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভের সাথে সম্পর্কিতভাবে হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছিল। বিশেষ করে, র্যাবের কালো হেলিকপ্টার বিক্ষোভকারীদের ভীতি প্রদর্শন এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। সিনিয়র কর্মকর্তাদের মতে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশেষভাবে আরও বেশি হেলিকপ্টার মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে র্যাবের পূর্ববর্তী কৌশলের মতোই বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানো যায়।
এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্নজনের সাক্ষী নিয়েছে ওএইচসিএইচআর। সেই সাক্ষ্য অনুযায়ী, ১৮ জুলাই মিরপুর ও মহাখালী, ১৮ ও ১৯ জুলাই ধানমন্ডি, ১৯ জুলাই বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, রামপুরা ও শাহবাগ, ১৯ জুলাই এবং ২ ও ৩ আগস্ট বসুন্ধরা, ২০ জুলাই গাজীপুর এবং ২০ ও ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে বারবার র্যাব বা পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও, ১৮ জুলাই রামপুরায় সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছিল।
‘সাক্ষীদের ভাষ্যমতে, ১৯-২১ জুলাই সময়কালে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর এবং রামপুরায় হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগানের মাধ্যমে প্রাণঘাতী গোলাবারুদ নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ৫ আগস্ট যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় একজন ব্যক্তি আর্মার-পিয়ার্সিং গুলির টুকরোর আঘাতে আহত হন, যা পরে ওএইচসিএইচআর দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। ’
এই ঘটনায় প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো স্বভাবতই নির্বিচার, যা মানবাধিকার মানদণ্ডের লঙ্ঘন। এক সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, এই ধরনের অস্ত্র নির্দিষ্টভাবে এমন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে ব্যবহার করা সম্ভব নয়, যারা সরাসরি মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আসন্ন হুমকি সৃষ্টি করছে।
হেলিকপ্টারে গুলির প্রশ্নে পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালকের বক্তব্য নিয়েছে ওএইচসিএসআর। সেখানে পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালক স্বীকার করেছেন যে, র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তবে তারা নিশ্চিত করতে পারেননি যে, র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল কি না। র্যাব ওএইচসিএইচআরের কাছে জানিয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি টিয়ার গ্যাস শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তবে কোনো রাইফেল বা শটগান ব্যবহার করা হয়নি।
তবে হেলিকপ্টার ব্যবহারের ঘটনায় ভিডিও সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেছেন। সে বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওএইচসিএইচআর একাধিক ভিডিও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে, যেখানে র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে টিয়ার গ্যাস লঞ্চার ব্যবহারের দৃশ্য দেখা গেছে। এই লঞ্চারগুলো দূর থেকে রাইফেল বা শটগানের মতো দেখাতে পারে, তবে টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ছোড়ার সময় একটি স্বতন্ত্র সাদা ধোঁয়ার রেখা সৃষ্টি করে। ওএইচসিএইচআর এমন কোনো ভিডিও সংগ্রহ করতে পারেনি যেখানে স্পষ্টভাবে হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়া হয়েছে। তবে এটি লক্ষণীয় যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা যে সময়গুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তখন সরকার মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে রেখেছিল, ফলে সামাজিক মাধ্যম বা ওয়েবসাইটে ভিডিও প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।
‘সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে, ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত বা নাকচ করতে পারছে না যে, হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল কি না। এটি সম্ভব যে, ওপর থেকে আসা কিছু গুলি আসলে উঁচু স্থানে অবস্থান নেওয়া বন্দুকধারীদের দ্বারা ছোড়া হয়েছিল, অথবা আকাশে নিক্ষিপ্ত গুলি পরে নিচে পড়ে গিয়ে কারও গায়ে লেগেছে, কিংবা কোনো বস্তুতে লেগে প্রতিক্ষিপ্ত হয়ে ভুক্তভোগীদের আঘাত করেছে। বিষয়টি আরও তদন্তের প্রয়োজন’ বলে মনে করছে সংস্থাটি।