নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় সজাগ থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

ওসমানী মিলনায়তনে নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: বিটিভি
সম্প্রতি নারীদের ওপর বিভিন্ন হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তেব্যে তিনি বলেন, “এটি নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এই নতুন বাংলাদেশে নারী-পুরুষ সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা আমাদের সকল শক্তি প্রয়োগ করে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করব।”
নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবাইকে সজাগ থাকারও আহবান জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “পতিত স্বৈরাচার দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। আমাদেরকে এখন ততটাই সতর্ক থাকতে হবে যেমনটা আমরা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বোচ্চ সজাগ থাকুন। নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্য গড়ে তুলুন। একে অন্যের পাশে দাঁড়ান। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে সরকারকে সহযোগিতা করুন।”
বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও একাত্তরের সংগ্রামী নারীদের এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
গণ-অভ্যুত্থানে সম্মুখসারিতে থাকলেও এখনো অনেকক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে আছে বলে মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে দুঃস্থ মায়েদের আর্থিক সহায়তা, নারীদের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, কর্মজীবী নারীদের হোস্টেল এবং ডে কেয়ার সেন্টার সুবিধাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
আরও কী কী করা যেতে পারে সেটা নিয়েও আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা নারীবিরোধী শক্তি মোকাবেলার গুরুত্ব এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও আইনি সহায়তা দেওয়ার বিষয়েও কথা বলেন।
তিনি বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। অনেক সময় নারীরা নির্যাতনের শিকার হলেও তারা বুঝতে পারেন না কোথায় অভিযোগ জানাবেন। নারীরা যেন তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন সেজন্য হটলাইন চালু করা হয়েছে।
“আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য আমরা পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিয়েছি। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০২৫ প্রণয়নের কাজও আমরা হাতে নিয়েছি। আমরা একটি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন করেছি, তারাও তাদের সুপারিশগুলো দেবে।”
প্রধান উপদেষ্টা ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’ এ নারীদের অংশগ্রহণ এবং সমাজে নারীর অধিকার ও অংশগ্রহণে পুরুষদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের কথাও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “হাজার হাজার দর্শকের এমন উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের সমাজে নারীর অধিকার ও অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠায় পুরুষদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে।”
নারীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নারীবিরোধী যে শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে আমরা দেশের সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই মোকাবেলা করব।
সমাজে এখনো অনেকেই নারীদের অবজ্ঞা করে, যা বদলানো প্রয়োজন, বলেন তিনি।
“অথচ নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে, বৈষম্যহীন, সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে হলে নারীর পাশে দাঁড়ানোর, তাদেরকে সমর্থন জানানোর কোনো বিকল্প নেই।”
নারীরা যতটুকু অধিকার আর স্বাধীনতা চর্চা করতে পারছেন এর পুরোটাই তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হয়েছিল নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা কমানো, বেতন বৃদ্ধি ও ভোটের অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামেন। অধিকার আদায়ের জন্য আহত ও নির্যাতিত হন।
“বাংলাদেশেও নারীরা ন্যায্য অধিকারের জন্য যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে এসেছে। তেভাগা থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারীসমাজ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসের অনেক বীর নারীদের আমরা ভুলে গেছি, তাদের অবদানের কথা জানি না। কিন্তু জুলাই কন্যাদের নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের কথা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে দেব না।”
তিনি বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীরা বিভিন্ন সময়ে আমাকে তাদের সংগ্রাম ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া তা সম্ভব হবে না। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদের সাথে পুরুষদেরও সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করতে হবে।”
সমাজে নারীদের ন্যায্য স্থান প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষদেরকে উৎসাহী সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মুহাম্মদ ইউনূস।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা কয়েকজনের হাতে অদম্য নারী পুরস্কার তুলে দেন।
পুরস্কার পাওয়া নারীরা হলেন- অর্থনীতিতে শরিফা সুলতানা, শিক্ষা ও চাকরিতে হালিমা বেগম, সফল জননী মেরিনা বেসরা, জীবন সংগ্রামে জয়ী লিপি বেগম, সমাজ উন্নয়নে মো. মুহিন (মোহনা), বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল।