হাতকড়া কি বীর মুক্তিযোদ্ধার অলঙ্কার? শুনানিতে কামাল মজুমদার
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর শুনানিতে সাবেক শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার কড়া পরা হাত দেখিয়ে বলেছেন, এটা কি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অলঙ্কার?
পরে এর জবাবে খেদ প্রকাশ করে সরকারি কৌঁসুলি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দেবেন না। মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগ ‘কলঙ্কিত’ করে ফেলেছে।
সোমবার সকালে ঢাকার মহানগর হাকিম জি এম ফারহান ইসতিয়াকের আদালতে নেওয়া হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও বাড্ডা থানা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি গোলাম সারোয়ার পিন্টুকে।
এসময় মিরপুরের মহিউদ্দিন হত্যা মামলায় কামাল আহমেদ মজুমদারকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানিতে সাবেক এ শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কথা বলার অনুমতি চাইলে বিচারক সেই সুযোগ দেন।
কামাল মজুমদার বলেন, “এভাবে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, নির্যাতন করা হচ্ছে। এই সরকারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, দেশে আইনের শাসন থাকলে এমনটা হত না। মামলা করছে, বাদীর খবর নাই।
“একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন করছে। পরিবারের সদস্যদেরও নির্যাতন করছে। তারা বাড়িতে থাকতে পারছে না। জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।”
এসময় হাতকড়া পরা হাত উঁচিয়ে আদালতকে তিনি বলেন, “এটাই কি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অলঙ্কার? এজন্যই কি দেশ স্বাধীন করেছিলাম?”
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন কামাল মজুমদার। তিনি বলেন, “কোনো অন্যায়, দুর্নীতি করিনি। অথচ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এর বিচার চাই।
“আদালতের প্রতি আমাদের সম্মান, শ্রদ্ধা রয়েছে। যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করছি।”
এসব কথার জবাবে পরে ঢাকা মহানগর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “তিনি একজন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা না। রাজস্ব ফাঁকি দিতে রাজনীতিতে নাম লেখান। এলাকায় অবৈধভাবে বিশাল ব্যবসা তৈরি করে নিয়েছেন।
“আন্দোলনের সময় মিরপুরে জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, তিনি কোনো নতুন গ্রহ থেকে এসেছেন।”
কামাল মজুমদারের ‘বাদীর খবর নাই’ মন্তব্যের জবাবে পিপি বলেন, “এখন বাদী আসবে কেন? রাষ্ট্র এসব মামলার দায়িত্ব নিয়েছে। বিচারের সময় বাদী আসবেন।”
‘মিথ্যা মামলার’ অভিযোগের বিষয়ে শুনানিতে ফারুকী বলেন, “এমন নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে বাচ্চাদের খুন করা হয়েছে- আর উনি বলছেন, ‘মিথ্যা মামলা করা হয়েছে’।
“ইসরায়েল গাজায় মুসলিমদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেছে। এরাও তাই করেছে। পেট্রোল দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে। আর উনি বলছেন মিথ্যা মামলা।”
সাবেক প্রতিমন্ত্রীর পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে কৌঁসুলি ফারুকী বলেন, “অবৈধ অর্থ তো শুধু আপনার নামে রাখেননি। ভোগ করছে পরিবারের সদস্যরাও।
“চিন্তা করেন, এমন কাজ করলে পরিণাম তো পরিবারকে ভোগ করতেই হবে। সম্পত্তি লুট করেছেন। সরকারের সম্পদ তো রাখেননি। সব খাস জমি দখল করে নিয়েছেন।”
কামাল মজুমদার বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়ায় খেদ প্রকাশ করেন পিপি ওমর ফারুক ফারুকী।
তিনি বলেন, “যারা মুক্তিযোদ্ধা, আপনাদের কারণে তাদের সম্মানহানি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মাটির নিচে মিশিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ কি একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের এজেন্সি? কেন মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করলেন? আর আজ বলছেন মুক্তিযোদ্ধা।
“আমি বলছি, আপনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিবেন না। গুম, খুন, আয়নাঘর এগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল? মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জনগণকে খুশি অথবা কাজ না করলে এমন পরিণাম ভোগ করতে হয়।”
পিপির বক্তব্যের জবাবে পরে কামাল মজুমদার বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, আমি ব্যবসায়ী। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করেছি। আর গর্বের সাথে বলতে চাই, সরকারের সাথে ব্যবসা নিয়ে কোনো সম্পর্ক নাই। কোনো কারচুপির আশ্রয় নেইনি। ট্যাক্স দিয়েছি নিয়মিত।”
ঢাকা-১৫ আসনের সাবেক এ সাংসদ বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্বিত, আইনজীবী যা বলছেন- সত্য না। এলাকায় স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট করেছি; উন্নয়ন করেছি।
“কোনো লোকের কাছ থেকে এক কাপ চাও খাইনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। বাজার সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি।”
আওয়ামী লীগের পাঁচবারের এই এমপি বলেন, “আমি সবসময় আন্দোলনকারীদের পক্ষে বলেছি। শেখ হাসিনাকে বলেছি, ‘দাবি মেনে নেন’। বারবার বলেছি।
“যার কারণে আমার গণভবনে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আর চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে চাই, সরকারি জমি দখল করিনি বা কোনো জমি বরাদ্দ নেইনি।”
পরে আদালত তাকে মহিউদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ৫ অগাস্ট মিরপুর মডেল থানার সামনে অবস্থান করছিল ছাত্রজনতা। তখন ওই স্থান পার হওয়ার সময় গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মহিউদ্দিন। পরে ৮ অগাস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় গত ১২ সেপ্টেম্বর মিরপুর থানায় হত্যা মামলা হয়।
এদিকে মিরপুরের রাকিব হোসেন হত্যা মামলাতেও এদিন কামাল আহমেদ মজুমদারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।