টাঙ্গাইলের ফারুক হত্যা: ২জনের যাবজ্জীবন, খান পরিবারের সবাই খালাস
এক যুগ আগে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদকে হত্যার ঘটনায় খান পরিবারের চার ছেলেসহ ১০ জনকে খালাস দিয়েছে আদালত; যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে দুইজনের।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মাহমুদুল হাসান রোববার আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আসামিদের মধ্যে কেবল সহিদুর রহমান খান মুক্তি রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন। অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক এ মেয়রকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- কবির হোসেন ও মোহাম্মদ আলী। একইসঙ্গে প্রত্যেককে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা দুইজনেই পলাতক রয়েছে।
খান পরিবারের খালাস পাওয়ারা হলেন- আমানুর রহমান খান রানা, সহিদুর রহমান খান মুক্তি, জাহিদুর রহমান খান কাঁকন ও সানিয়াত খান বাপ্পা। এছাড়া মাসুদুর রহমান, ফরিদ হোসেন, নাসির উদ্দিন নুরু, আলমগীর হোসেন চাঁন, ছানোয়ার হোসেন ও দারোয়ান বাবু ওরফে দাঁত ভাঙা বাবু খালাস পেয়েছেন।
এর বাইরে আনিসুল ইসলাম রাজা ও সমির মিয়া বিচার চলাকালে মারা যান।
ফারুক আহমেদের ছেলে আহমেদ মজিদ সুমন বলেন, “বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিরা বিচারপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। এই মামলার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতারা। তারা ৫ অগাস্টের পর আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
“এসব আইন কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগেও যারা ছিলেন, তারা আসামিদের ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী নাসির উদ্দিন খান বলেন, “এই মামলায় ২৭ জনের স্বাক্ষী রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করেছিল। আসামিদের নাম কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে- তারা এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিল।
“যখন ঘটনা দেখানো হয়েছিল তখন সহিদুর রহমান খান মুক্তি সস্ত্রীক ভারতে ছিলেন চিকিৎসার জন্য, তার ভাই কাঁকন মালয়েশিয়াতে ছিল, সাবেক এমপি রানা ঘাটাইলে একটি অনুষ্ঠানে ছিল এবং তাদের ছোট ভাই বাপ্পা ঢাকায় ছাত্রলীগের অফিসে ছিলেন।”
আইনজীবী নাসির বলেন, “রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছিল। এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছি।”
রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি মোহাম্মদ সাইদুর রহমান স্বপন বলেন, “যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে ২৭ জন সাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা, কয়েকজন আসামি ও সাক্ষীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে আদালতকে শোনানো হয়।
“বিচারক মামলার আসামি মোহাম্মদ আলী এবং কবির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। এছাড়া ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। আর সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিনভাইসহ ১০ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারক।”
বাদীর সঙ্গে আলোচনা করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরে আওয়ামী লীগের টাঙ্গাইল জেলা কমিটির সদস্য ফারুককে তার বাসার সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তিন দিন পর ফারুকের স্ত্রী নাহার টাঙ্গাইল মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন।
তবে পরে নাহার সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই তাকে হত্যা করা হয় এবং টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
রানাদের চাচা শামসুর রহমান খান শাহজাহান আওয়ামী লীগের নেতা ও সংসদ সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ভাতিজারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন।
মামলার তদন্ত চলাকালে খান পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আনিসুল ইসলাম রাজা এবং মোহাম্মদ আলী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে রানাদের চার ভাইকে জড়িয়ে বক্তব্য দেন তারা।
হত্যাকাণ্ডের তিন বছর বাদে ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। সেখানে রানা ও তার তিন ভাইসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থিতা থেকে সরে যেতে রাজি না হওয়ায় সাংসদ রানার সহযোগী কবির হোসেন পিস্তল দিয়ে ফারুক আহমদকে গুলি করেন। পরে সাংসদের নির্দেশে আনিসুল, মোহাম্মদ আলী, আবদুল হক, সমির ও কবির লাশ নিয়ে ফারুকের বাসার সামনে ফেলে রেখে আসেন।
২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর উপনির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ নির্বাচিত হন আমানুর রহমান খান রানা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
রানা এক সময় টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের চার ভাইকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় জেলা আওয়ামী লীগ।
২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। বিচার চলাকালে দুই আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা ও সমির মিয়া কারাগারে মারা যান। গত ২৬ জানুয়ারি ফারুক হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শেষে রোববার রায় ঘোষণা করা হলো।
প্রভাবশালী খান পরিবারের কে কোথায়: টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি একসময় শামসুর রহমান খান ওরফে শাহজাহান এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী শিবিরে বিভক্ত ছিল। ভারতে এক যুগেরও বেশি সময় নির্বাসিত থাকার পর নব্বই দশকের শুরুতে দেশে ফেরেন বঙ্গবীর। আর তখনই ওই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহজাহানের পক্ষে বাহিনী গড়েন তার ভাতিজা আমিনুর রহমান খান ওরফে বাপ্পি, আমানুর রহমান খান ও সহিদুর রহমান খান মুক্তি। শহরের একটি অংশের নিয়ন্ত্রক এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়, কারাবরণও তরতে হয় তাদের।
২০০৩ সালে সন্ত্রাসী হামলায় খান পরিবারের বড় সন্তান আমিনুর রহমান খান নিহত হন। তখন বাহিনীতে যোগ দেন তাদের দুই ভাই জাহিদুর রহমান খান ও সানিয়াত খান বাপ্পা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খান পরিবারের সন্তানদের প্রভাব আরও বাড়ে। ২০১২ সালে টাঙ্গাইল-৩ আসনের উপনির্বাচনে সাংসদ হন খান পরিবারের ছেলে রানা। এর আগে ২০১১ সালে তার ভাই সহিদুর রহমান খান টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
অপর ভাই জাহিদুর রহমান খান বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব নেন। আর ছোট ভাই বাপ্পা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি হন। তাদের দাপটে পুরো জেলার ব্যবসা–বাণিজ্য, রাজনীতি, ঠিকাদারি-সবই খান পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
ফারুক হত্যা মামলায় আমানুর রহমান খান রানা আত্মসর্মপণের পর তিন বছর কারাগারে ছিলেন। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। গত বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তার অপর দুই ভাই ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন। রানার আরেক ভাই সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি অন্য একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
রানার বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। সহিদুর রহমান খান মুক্তির বিরুদ্ধেও পাঁচটি হত্যাসহ অন্তত ৪০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া জাহিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা এবং সানিয়াত খান বাপ্পার বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা হয়েছে।
এত মামলা হলেও তাদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। কখনও তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে। আবার কখনও আসামিদের চাপে বাদীপক্ষ মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ভয়ে কেউ কখনো আদালতে সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে যায়নি।
এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা থাকলেও এর আগে কোনোটিরই রায় হয়নি। এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো যে মামলার রায় হলো, তাতে তারা সবাই খালাস পেলেন।