‘বেশি আয়ের’ টোপে কুমিল্লায় মাদক বহনে নারীরা
কুমিল্লায় ‘বেশি আয়ের’ লোভ দেখিয়ে নারীদের দিয়ে মাদক পরিবহন চলছে দেদারছে।
ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য কুমিল্লা সীমান্ত পথে বাংলাদেশে আসে। এসব মাদক পরিবহন ছাড়াও স্থানীয়ভাবে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণেও কাজে লাগানো হচ্ছে অসহায় ও দরিদ্র নারীদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মজুরি বৈষম্যের কারণে হতাশা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেশি অর্থের লোভে দরিদ্র নারীরা এ পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
২০২৪ সালে কুমিল্লা জেলা পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে দুই শতাধিক নারী মাদক বহনকারী ও ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই তরুণী এবং মধ্যবয়সী।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরাফাতুল ইসলাম বলছেন, “গত বছর কুমিল্লা জেলায় মাদক মামলায় ১৭১ নারী গ্রেপ্তার হয়েছেন।
“এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কুমিল্লা কার্যালয়ের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩২ জন। যাদের বেশির ভাগই মাদক পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল।”
বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০২৪ সালে মাদক পরিবহনে নারীদের সম্পৃক্তার হার ‘বেড়েছে’ বলে এ পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেছেন।
সাধারণত পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদকপাচার রোধে বিভিন্ন সময় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে মাদকবিরোধী অভিযানে সেনাবাহিনীও সহযোগিতা করছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, নারীরা ‘বডিফিটিং’ (শরীরে বেঁধে) কিংবা শরীরে প্রবেশ করিয়ে মাদক পরিবহন করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম- এমনটা মনে করে তাদের এই অবৈধ কাজে সম্পৃক্ত করানো হচ্ছে।
বিজিবি-১০ কুমিল্লা ব্যাটালিয়নের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে কুমিল্লা সীমান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মদ, গাঁজা, ইয়াবা পাচার হয়। এ ছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফ, ফেনীর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে কুমিল্লার ওপর দিয়েই বাস, ট্রাক বা প্রাইভেট কারে পাচার হয় মাদক। সাধারণত বাসে মাদকের তল্লাশির সময় যাত্রীবেশে নারী মাদক পাচারকারী গ্রেপ্তার হচ্ছে ‘বেশি’। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, শুধু পরিবহন করাই তাদের কাজ। এর বিনিময়ে মেলে মোটা অঙ্কের টাকা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক চৌধুরী ইমরুল হাসান বলছেন, “টাকার লোভ দেখিয়ে নারীদের মাদক পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি তল্লাশির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ নারীদের কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবেই এড়িয়ে যায় বলে, মাদক কারবারীরাও এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
“যেসব নারী মাদকপাচারে জড়িত, তাদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের; খুব অল্প বেতনে তারা কাজ করতেন বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে এমনও তথ্য জানা গেছে, কে বা কাদের মাধ্যমে তারা গাঁজা-ইয়াবা পাচার করছে তাও তারা জানেন না। তাদের কাজ শুধু টাকার বিনিময়ে পাচার করা।”
ইমরুল বলন, “সম্প্রতি অভিযানে একই পরিবারের বাবা, মা ও মেয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এ ছাড়া বাড়ির গৃহকর্মীর কাজ করত এমন এক তরুণীকে এক মাসের বেতনের দ্বিগুণ টাকা এক ট্রিপে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মাদক পরিবহন করানো হয়েছে- এমন তথ্যও রয়েছে। এ ছাড়া বাজারের ব্যাগে শাক-সবজির আড়ালে গাঁজা পরিবহনের সময়ও ধরা পড়েছেন একাধিক নারী।”
২০২৪ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ৩২ জন আটক হয়েছেন। বিগত সময়ে মাদকের অভিযানে এত নারী ধরা পড়েনি বলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তার ভাষ্য।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে ১১ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার হন ফরিদপুরের সালথা এলাকার কাকলি আক্তার।
তার বরাতে ইমরুল বলেন, তিনি ঢাকায় বাসা-বাড়িতে কাজ করতেন। বাসার কাজের সারা মাসে যে টাকা পান তা একদিনে পাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাকে গাঁজা পরিবহন করতে বলা হয়।
এর আগে ২০ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে গাঁজাসহ আটক করা হয় বুড়িচং উপজেলার কল্পনা ও কুলসুমকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে তারা জানায়, সংসারের খরচ জোগাড় করতে এই কাজে নেমেছেন তারা।
এর আগে ১৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা নগরীর ধর্মপুর এলাকা থেকে বিক্রির জন্য প্যাকেট করা গাঁজাসহ শাফিয়া আক্তার নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, তিনি পেশাদার মাদক বিক্রেতা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানা গেছে, মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত নারীরা যে শুধু কুমিল্লা জেলার বাসিন্দা এমন নয়, বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নারীরাও গ্রেপ্তার হয়েছেন কুমিল্লায়।
মাদক পরিবহনে নারীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক চৌধুরী ইমরুল হাসান বলেন, “আমাদের বাহিনীতে নারী সদস্য সংখ্যা কম। তাই নারী মাদক পাচারকারী বা বহনকারীদের তল্লাশি চালাতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।”
মাদক মামলা নিষ্পত্তি নিয়ে কাজ করেন কুমিল্লা জেলা আদালতের আইনজীবী গাজী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম মানিক। তিনি বলছিলেন, “আমরা যতগুলো মাদকের মামলা নিয়ে কাজ করছি তার মধ্যে ৩০ শতাংশ নারীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যারা জীবিকার তাগিদে কাজ খোঁজেন বা নিম্ন আয়ের নারী, তাদের বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে মাদক বহনে ব্যবহার করা হয়। মজুরি বৈষম্যের কারণে হতাশা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং বেশি অর্থের লোভে দরিদ্র নারীরা এ পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
“অথচ মূল যে ব্যবসায়ী সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, কিন্তু যার কাছে মাদক পাওয়া যায় তার এই শাস্তি হয়। নারীদের জন্যও একই শাস্তির বিধান-মাদকের মামলায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের সাজাও হতে পারে।”
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সদস্য সমাজকর্মী আইরিন মুক্তা অধিকারী বলেন, “শুধু সচেতনতা তৈরি করে এরকম অপরাধ থেকে নারীদের দূরে রাখা যাবে না। বরং রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে পাওয়া যেতে পারে।”
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নারী শ্রমিক অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। নতুন কোনো বৈধ কর্মসংস্থান না পেলে এসব নারীদের মাদক পরিবহনসহ নানা অপকর্মের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। এজন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।”
এদিকে কুমিল্লার আদালতে মাদক মামলার জট এবং বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিচার হয় না। অনেক নারী মাদক ব্যবসায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের পর জেল-জরিমানা খেটে বেরিয়ে আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে বলেও জানা গেছে।
কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী বদিউল আলম সুজন বলেন, “মাদকের মামলার বিচার কাজে আমরা পুলিশের তদন্তে গাফিলতি লক্ষ্য করি। এসব গাফিলতির কারণেও কিন্তু পুরুষ এবং নারী আসামিরা পার পেয়ে যায়। মাদকের যে পরিমাণ মামলা হচ্ছে, তারচেয়ে কম নিষ্পত্তি হচ্ছে। যে কারণে জট বাড়ছে। সেক্ষেত্রে একটি ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের মাধ্যমে এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব।”
কুমিল্লা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কাইমুল হক রিংকু বলছিলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, মাদকের মামলার জট কমিয়ে আনতে। আমাদের কুমিল্লা আদালতে একটি আলাদা ভাগ রয়েছে যেখানে মাদকের মামলা নিষ্পত্তি হয়। আমরা চেষ্টা করব তদন্তকারী সংস্থার সক্রিয়তায় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে।”
মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরাফাতুল বলেন, “মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সচেতনামূলক সভায় পুলিশ অংশ নিচ্ছে। পাশাপাশি সীমান্ত বা যেসব এলাকায় মাদকের প্রবণতা বেশি, সেখানে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে নিজেরদের মত করে প্রচার চালাচ্ছে পুলিশ।”