রোহিঙ্গা শিশুদের অপহরণের টোপ ‘খেলার সাথী’
ছোট্ট একটি শিশুকে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। গলা পর্যন্ত মাটি দিয়ে ঢাকা। শিশুটি বারবার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। বেশ কয়েক সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও পাঠানো হয়েছে তার বাবার কাছে।
সেই ভিডিও পাওয়ার পর কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দু রহমান, যার ছয় বছর বয়সী ছেলের খোঁজ মিলছিল না দুইদিন ধরে।
ভিডিওটি হাতে পাওয়ার পর মধ্যবয়সী এ বাবা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন; বুঝতে পারেন তার ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণকারীরাই সেই ভিডিও পাঠিয়েছেন, সঙ্গে মুক্তিপণের বার্তা; দাবি করা হয়েছে সাত লাখ টাকা।
কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে বসবাসকারী আব্দু রহমানের জীবনে আবারও যেন দুর্যোগ ডেকে আনে এ ঘটনা। আট বছরের শরণার্থী জীবনে আবার ফিরে এসেছিল অসহায়ত্ব, যেমনটা ঘটেছিল ২০১৭ সালে হামলা আর নির্যাতনের মুখে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার সেসব দিনগুলোতে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার বছর দুয়েক পর উখিয়ার এই আশ্রয় শিবিরেই জন্ম তার এই ছেলের। সপরিবারে এখন থাকেন সেখানকার ১৯ নম্বর ক্যাম্পের সি-১৫ ব্লকে।
ছয় বছরের ছেলেকে চলতি মাসের শুরুর দিকের হঠাৎ একদিন খুঁজে না পাওয়ার বর্ণনা দিয়ে আব্দু রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ড্টকমকে বলেন, শিশুটি প্রতিদিনের মত ৮ জানুয়ারি দুপুরে ক্যাম্পের মাঠে খেলাধুলা করতে যায়। সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও সে ঘরে ফেরেনি। এরপর ক্যাম্পজুড়ে খুঁজেও তার সন্ধান মেলেনি। পরপর দুদিনেও ছেলের সন্ধান পাচ্ছিলেন না তিনি। পুরো পরিবারের সদস্যরা মুষড়ে পড়েন।
দিন দুয়েক পর তার কাছে একটি ভিডিও আসে। সেখানে তিনি দেখতে পান, তার ছেলের শরীরের অনেকটা অংশ মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে। ছেলেটি বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন তার ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। এরপর অপহরণকারীরা সাত লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে বার্তা পাঠান।
আব্দু রহমান বলেন, “প্রথমে আমরা অপহরণকারীদের কাছে ৫০ হাজার টাকা পাঠাই। কিন্তু আমার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে হয়রানি করা হয়। সবশেষ দুই লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমি আমার সন্তানকে ফিরে পাই।”
ছেলের অপহরণ ও মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনার আগে-পরে ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পাত্তা পাননি সেখানে।
আব্দু রহমানের দাবি, ১২ জানুয়ারি ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে সন্তানকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করেছিলেন। পরে সেটি উখিয়া থানা পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু তেমন সাড়া পাননি তিনি। এমনকি উদ্ধারের পরেও পুলিশকে অবহিত করেছিলেন। তবে রহস্যের কিছুই উদঘাটন হয়নি।
এ ঘটনায় উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একজন গরিব রোহিঙ্গার পক্ষে কীভাবে এত টাকা দেওয়া সম্ভব সেই প্রশ্ন তোলেন বলে অভিযোগ তার।
টাকা জোগাড় করার বিষয়ে রহমানের ভাষ্য, “আমি আমার আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ধার নিয়েছি। বাকি টাকা মসজিদের মাধ্যমে চাঁদা তুলেছি।”
এ সংক্রান্ত আবেদনের দুটি কপি রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমকে দিয়েছেন।
তবে রহমান এখনও জানেন না তার ছেলে কীভাবে বা কাদের মাধ্যমে অপহরণ করা হয়েছিল।
সম্প্রতি আব্দু রহমানসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হলে তারা ‘ভিন্ন ধরনের’ এমন অপহরণের কথা তুলে ধরেন। যেখানে সাধারণত ‘খেলার সাথীদের’ ব্যবহার করে শিশুদের অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা টাকা বা নতুন কোনো জিনিসের লোভ দেখিয়ে এসব কাজে শিশুদের ব্যবহার করছে।
‘খেলার সাথীদের’ টোপ হিসেবে ব্যবহার করে এ ধরনের অপহরণের বেশ কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়েছে; যার কয়েকটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে এসেছে।
উখিয়ার আশ্রয় শিবিরের এক মাঝি (রোহিঙ্গাদের নেতা) এনায়েত উল্লাহ বলেন, নানা কারণে ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যেতে চায় না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে যেমন পড়তে হয়, তেমনি খুব একটা সমাধানও মেলে না।
শিশুদের অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দ্দৌজা বলেন, “অপহরণের ঘটনাগুলো নিয়ে আমরাও অবগত। বিষয়টি নিয়ে এপিবিএনের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। ক্যাম্পের অনেক অপরাধ এখন কমে এসেছে, উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে অপহরণের বিষয়েও।”
রোহিঙ্গা শিবির থেকে শুধু এমন শিশু অপহরণ নয়, সাম্প্রতিক সময়ে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় সব ধরনের অপহরণ ব্যাপক বেড়েছে।
অহরহ সাধারণ গ্রামবাসী থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা নাগরিক অপহরণের শিকার হওয়ার খবর আসছে। মুক্তিপণের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই অপহরণের ঘটনা ঘটছে উপকূলীয় এলাকায়।
কোনো কোনো দিন দু-তিনটি অপহরণের ঘটনাও ঘটছে। কিছুদিন আগে পাহাড়ে বনবিভাগের ১৮ কর্মী গাছ লাগাতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়। অপহরণের পর ভুক্তভোগীদের গভীর জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা ’সন্ত্রাসীদের’ যোগসাজশের কথা উঠে আসছে।
তবে অধিকাংশ ভুক্তভোগীই এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যেতে চান না বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। অপরদিকে স্বল্প জনবল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেও আশ্রয় শিবিরের মত বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জের বলে তাদের ভাষ্য।
বড়দের অপহরণের ঘটনার পাশাপাশি এখন রোহিঙ্গা শিবিরের শিশুরা শিকার হচ্ছেন অপহরণের; যাদের বিভিন্ন উপায়ে তুলে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণের দাবিতে নির্যাতন করা হয়। সেই ভিডিও পাঠানো হয় অভিভাবকদের কাছে।
এসব অপহরণের ক্ষেত্রে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় শিশুদের খেলার সঙ্গী-সাথীদের।
শিশু অপহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনার ভিডিওতে তেমন তথ্য উঠে আসে। ঘটনাটি কুতুপালং ক্যাম্পের। সেখানকার বাসিন্দা এক শিশুকে অন্য এক শিশুকে অপহরণে সহযোগিতার দায় স্বীকার করতে দেখা গেছে।
৫ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের ওই ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে, কিছু লোক শিশুটিকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। সে কেঁদে কেঁদে কথা বলছিল এবং তাকে ভীত দেখাচ্ছিল।
রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ভাষায় আট-নয় বছরের এই কন্যাশিশুকে বলতে শোনা যায়, “আব্দুর শুক্কুর নামের এক লোক আমাকে ডেকে বলে একটা ছোটো ছেলেকে যদি এনে দিতে পারি ৫০০ টাকা দেবে। জামা কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারলে আরো ৫০ টাকা দেবে।”
ওই ভিডিওতে শিশুটি নিজের পরিচয়ও বলেছে; যা ঠিক বলে জানিয়েছেন ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা।
অপহরণের পর নির্যাতনের আরেকটি ভিডিও এসেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হাতে। ৪১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সবুজ শার্ট ও নীল প্যান্ট পরিহিত ছয়-সাত বছরের এক শিশুকে মাটিতে ফেলে নির্যাতন করা হচ্ছে। মারধরের তীব্রতায় তার মুখে থাকা খাবার সে বমি করে ফেলার চেষ্টা করছে।
শিশুটি চিৎকার করছিল, তার মধ্যেই তাকে মারধর করা হচ্ছিল। একপর্যায়ে শিশুটির গলাচেপে ধরা হয়। শিশুটির চোখ উল্টে আসছিল। তবে শেষ পর্যন্ত শিশুটির কী হয়েছিল তা জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কম।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা এ ভিডিও দেখে বলছেন, এ ধরনের ভিডিও রোহিঙ্গা শিবির থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া শিশুদের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। ভিডিও দেখে ধারণা করা যায়, এগুলো কোনো পাহাড়ি এলাকার।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের কয়েকটি ক্যাম্পের মাঝি (রোহিঙ্গাদের সামাজিক নেতা) ও সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ ধরনের ভিডিওর সত্যতা পাওয়া গেলেও ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-এপিবিএন বলছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ বা ভিডিও তাদের নজরে আসেনি।
১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ সিরাজ আমীন বলছিলেন, “রোহিঙ্গারা বেশির ভাগ সময়ই কিছু ভিডিও নিজেরা তৈরি করে, যা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে নিজেদের নজরকাড়ার জন্য।“
এ ধরনের ভিডিও ও অপহরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “এ ধরনের অপহরণ হলে রোহিঙ্গারা আমাদের কাছে খুব আসেন না। তারা অনেক সময় নিজেরাই এসব সেটেল করে নেন। পুলিশের কাছে না এসে তারা যায় ইউএনএইচসিআর এর কাছে; না হয় ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়।”
ক্যাম্পের সামগ্রিক অপহরণ বিষয়ে তিনি বলেন, “বিভিন্ন কারণে এখানে অপহরণের মত ঘটনা ঘটে। তবে এগুলো অপহরণ না, যেমন-রোহিঙ্গাদের অনেকে অনলাইন জুয়া খেলে। এতে হেরে গেলে টাকা দিতে না পারলে আটকে রাখে। তখন পরিবারের কাছে ফোন করে বলে টাকা দিতে। কিন্তু কিসের জন্য আটকে রাখা হয়েছে সেটি বলে না।
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মাদক ব্যবসা করতে গিয়ে পাওনা টাকাকেন্দ্রীক ঘটনাকেও তারা অপহরণ হিসেবে চালিয়ে দেয়।”
সিরাজ আমীন বলেন, “তবে কিছু অপহরণের রিয়েল কেইস যে ঘটে না, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের লোকজন ফাঁকা পেয়ে কয়েকজনকে নিয়ে যায়। কিন্তু এ সংখ্যা খুবই কম।
“তবে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেক অপরাধ দমন করা সম্ভব করা সম্ভব হয়ে উঠে না।”
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, টেকনাফে ২০২৪ সালে ৬২টি অপহরণ মামলা রেকর্ড হয়েছে। পুলিশের উদ্ধার তালিকায় আছে ১৩৮ জন ভুক্তভোগী।
তবে ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের ভাষ্য, অপহরণের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি। এর মধ্যে স্থানীয় বাসিন্দা বেশি হলেও রোহিঙ্গারাও রয়েছেন।
ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, অনেকেই ফিরেছেন মুক্তিপণ দিয়ে।
উখিয়ার আশ্রয় শিবিরের ১২ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি এনায়েত উল্লাহ বলেন, “ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যেতে চায় না কারণ অনেক জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়। আর তেমন একটা সমাধান না পাওয়ায় কেউ যেতে চায় না।”
তিনি বলেন, “বেশিরভাগ ঘটনা জুয়া ও মাদককেন্দ্রীক হওয়ায় সত্যিকার অর্থে অপহরণ হওয়ার ঘটনাগুলোকেও পুলিশ অনেক সময় পাত্তা দিতে চায় না।”
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন বলেন, “প্রত্যেকটি ঘটনার পর অভিযোগ আসুক বা না আসুক পুলিশ তৎপর হয়েছে এবং অপহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন অপরাধীও ধরা পড়েছে। আর যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে তাদের ধরতে তৎপরতা অব্যাহত আছে।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের ইমেইলে করা হয়েছে।