মঙ্গলবার ২১ জানুয়ারি ২০২৫, মাঘ ৮ ১৪৩১, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

চার কমিশনের প্রতিবেদন: রাষ্ট্র সংস্কার কোন পথে?

 প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫

চার কমিশনের প্রতিবেদন: রাষ্ট্র সংস্কার কোন পথে?

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় লাগাম দেওয়া, মেয়াদে সীমা টানার মত নানা পদক্ষেপ, বয়স কমিয়ে তরুণদের সংসদে আসার সুযোগ দেওয়াসহ বড় পরিসরে সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে; একইসঙ্গে বিদ্যমান সংবিধানের মূলস্তম্ভের নানা জায়গাতেও রদবদলের সুপারিশ করা হয়েছে।

পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনা, জাতীয় সংসদ, নির্বাচনসহ বহু মৌলিক জায়গায় পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে রাষ্ট্র মেরামতে প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের মধ্যে চারটির কাছ থেকে।

এসব প্রতিবেদন হাতে পেয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলছেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেগুলো নিয়ে সামনের দিকে এগোতে চান তিনি।

বুধবার কমিশন প্রধানদের কাছ থেকে বিশদ প্রতিবেদন পাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের রোডম্যাপ তৈরিতে এ চার কমিশনকে আরও এক মাস সময় দেওয়া হবে।

রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে যে ১১টি কমিশন গঠন করেছে সরকার, সেগুলোর মধ্যে চূড়ান্ত হওয়া চারটির প্রতিবেদনে সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থায় বিস্তর পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কারকে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে সংস্কারের চেয়ে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন সব কিছু আমূল পাল্টে দেওয়া এসব সংস্কার কার্যক্রম কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দিহান বিশ্লেষকরা।

তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলছেন, প্রয়োজনীয় ও আবশ্যকীয় কিছু সংস্কার তিনি নির্বাচন আয়োজনের আগে শেষ করতে চান। যেগুলো থেকে যাবে, সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে রেখে যেতে চান তিনি।

বুধবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধানরা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন।

এরপর বক্তৃতায় তিনি বলেন, “সব জিনিস যেহেতু নির্বাচনের আগে সম্ভব হবে না, কাজেই কিছু জিনিস থেকে যাবে। সেটা চার্টারের (গণঅভ্যুত্থান সনদ) আঙ্গিকে যেন আমরা এগিয়ে যেতে পারি।

“এটাকে সামনে রেখে আমাদের এগোতে হবে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কাজে এগুলোকে নতুন করে পরিশীলিত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে সবাই একমত হতে পারি।”

২০২৪ সালে জুলাই-অগাস্টে প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এর তিন দিন পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরে। তুমুল সেই গণ আন্দোলনের দাবি পূরণে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বুধবার তেজগাঁওয়ে তার কার্যালয়ে চারটি সংস্কার কমিশনের প্রধান তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বুধবার তেজগাঁওয়ে তার কার্যালয়ে চারটি সংস্কার কমিশনের প্রধান তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

এর মধ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন।

এর মধ্যে বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অন্য চারটি কমিশন বুধবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

প্রথম ধাপে জমা পড়া প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কারে দেওয়া প্রস্তাবগুলো এসেছে আলোচনার অগ্রভাবে।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সংবিধানের মোট পাঁচটি মূলনীতির পাশাপাশি বাংলায় দেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ থেকে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার মত সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুইবার থাকার বিধানের পাশাপাশি সংসদ ও রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ চার বছর এবং আইনসভাকে ‘জাতীয় সংসদ’ ও ‘সেনেট’ নামে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করার সুপারিশও এসেছে এ কমিশনের তরফে। সংসদের সদস্য সংখ্যাও ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ করার সুপারিশও আছে প্রস্তাবে।

দেশের শীর্ষ পদগুলোতে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের সুপারিশও করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতার পাশাপাশি সংসদের দুই কক্ষের স্পিকার ও বিরোধী দল থেকে আসা দুই ডেপুটি স্পিকার এবং সরকার ও বিরোধী দলের বাইরের একজন সংসদ সদস্য থাকবেন এ কাউন্সিলে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব সাংবিধানিক কাউন্সিলের জন্য রাখার সুপারিশ করা হয়েছে সংস্কার প্রস্তাবে।

ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের অঙ্গীকার, দুর্নীতি বিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা ও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের প্রস্তাবসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন।

‘ভাঙা’ নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অন্তর্ভূক্তিমূলক করার পাশাপাশি সব অংশীজনকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৫০ সুপারিশ রেখেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। র‌্যাবের প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশও করা হয়েছে।

এছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এ কমিশন।

চারটি কমিশনের প্রতিবেদনের চেয়ে সরকার সেখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করবে, সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কমিশন কী প্রতিবেদন দিল এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হল সরকার কী নিল, সরকার কী নেবে। কারণ অতীতেও এই রকম বহু কমিশন হয়েছে। কারণ, কমিশন যেটা দিয়েছে, সেটা নিতে সরকার তো বাধ্য না। এবং অতীতে এই রকম বহু কমিশনের রিপোর্ট সরকার বাস্তবায়ন করেনি।

“এখানে বাস্তবায়ন কতটুকু হয়, সেটা হল মূল। এখন সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, সরকার তো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করবে, তখন বোঝা যাবে, জানা যাবে, অনুমান করা যাবে যে, সরকার কতটুকু নিচ্ছে এবং কীভাবে সেটা বাস্তবায়ন করবে।”

এক প্রশ্নে সাবেক এই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বলেন, “যেহেতু এই রকম একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, একটা অরাজনৈতিক সরকার তারা তো হয়ত চেষ্টা করবে, আমি আশাবাদী।

“সব কিছু তাদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। যেটুকু সম্ভব সেটা তারা এখন করবে। আর পরেরটা রাজনৈতিক সরকার আসলে তাদের উপর নির্ভর করবে।”

সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে ‘কিছু ভালো দিক’ পেলেও কিছু বিষয় ‘সমস্যাপূর্ণ মনে হচ্ছে’ অধিকার ও উন্নয়ন কর্মী খুশী কবিরের কাছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে মন্তব্য করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধান তৈরি, পরিবর্তন বা সংশোধন করা সম্ভব নয়। ফলে নির্বাচিত সরকার আসলে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হতেও পারে, নাও পারে।

“আমি যতটুকু দেখছি এবং বুঝছি রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কিছু মানবে না। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় যাবে।”

সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা তুলে নেওয়ার ফলে সংখ্যালঘুকরণের প্রক্রিয়াটা থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।

এই অধিকারকর্মী বলেন, “বহুত্ববাদ আনলেই এটা পরিবর্তন হচ্ছে না। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আছে- ধর্মীয়, জাতীয়, পেশাগত, সামাজিক হতে পারে- সেখানে যদি ধর্ম নিরপেক্ষ না রাখা হয়, সকল ধর্মকে সমান অধিকার নাই। রাষ্ট্রীয় ধর্ম যদি রেখে থাকে আর ধর্ম নিরপেক্ষতা যদি বাদ দিয়ে রাখে তাহলে এটা খুবই সমস্যা।”

সুপারিশগুলো নিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে, বাস্তবায়ন কীভাবে হবে এবং বাস্তবে কীভাবে দেখা যাবে তা নিয়ে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন খুশী কবির।

জাতীয় সংসদ ও সেনেট নামে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন; যাতে দুই কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।

নিম্নকক্ষে ৪০০টি আসনের মধ্যে ৩০০টিতে সংসদীয় আসনভিত্তিক নির্বাচন হবে। আর দেশকে আসনে ভাগ করে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসবেন একশত নারী।

নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করার সুপারিশ রেখেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ জন নির্বাচিত হবেন ১ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হিসাবে। মোট ১০৫ জনের পাঁচজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবেন রাষ্ট্রপতি।

অন্যদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের থেকে এবং বাকি অর্ধেক আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবী প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করা।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিষয়ে এক প্রশ্নে সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল বলেন, “দুই কক্ষ, এক কক্ষ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো যোগ্য লোকেরা, সৎ লোকেরা নির্বাচিত হয়ে আসছে কি না।

“এখন আফ্রিকার কোনো দেশে দুকক্ষ বিশিষ্ট আছে। কিন্তু তারা খারাপ লোকগুলোকে যেখানে মনোনীত করার বা কিছু নিয়োগেরও ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির হাতে। সেখানে যদি আপনি যোগ্য লোক না দেন, ভালো লোক না দেন, দলদাস খোঁজেন, তাহলে তো লাভ হবে না।”

প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ চার বছর এবং প্রধানমন্ত্রী পদে একজনের সর্বোচ্চ দুইবার আসার প্রস্তাবকে সমর্থন করার কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী পদে পরিবারতন্ত্র ঠেকানোর পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, “এক ব্যক্তি না শুধু আমি মনে করি যে, এক পরিবার থেকেও ধারাবাহিকভাবে দুজনের বেশি আসতে পারবে না বা ১০ বছর বিরতি না দিয়ে একই পরিবার থেকে আসতে পারবে না।”

এক্ষেত্রে বতসোয়ানাতে পরিবারের কেউ ২০ বছর পর এবং মরিশাসে ১২ বছর পর ক্ষমতায় আসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখানে যদি আমি দুইবার হলাম, আর হলাম না, আমার স্ত্রী হল, তারপরে আমার মেয়ে হল, তারপরে আমার নাতনি হল- সেটাতে কী বড় কোনো পরিবর্তন হয়?

“আমি যেটা বলছি, এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। পরিবারতন্ত্র থেকে আমাদের বের হওয়া দরকার। কারণ, পরিবারতন্ত্রও গণতন্ত্র বান্ধব নয়।”

নারীর জন্য যে ১০০টি আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করলেও প্রচলিত নিয়মে নির্বাচন হলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন খুশী কবির।

এ সুপারিশ কোনো রাজনৈতিক দল মানবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “নির্বাচিত এলাকায় একজন যথেষ্ট সময় দিয়েছে, পরিচিতি বাড়িয়েছে সে তো সেই এলাকা ছাড়তে চাইবে না। তখনই গণ্ডগোল লেগে যাবে কোন ১০০টা নারীর জন্য ঠিক করা হবে।

এটা নিয়ে আরও ভাবনা চিন্তা করার পরামর্শ দেন তিনি।

দলীয় প্রধানের মেয়াদ নির্ধারিত না করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই বার করা নিয়েও সমস্যা দেখছেন খুশী কবির।

তিনি বলছেন, কোনো ব্যক্তি পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী না হলেও তিনি যদি দলীয় প্রধান থেকে যান তাহলে প্রধানমন্ত্রীর উপর তার একটা প্রভাব থেকে যাবে।

“এটা নিয়েছে জগাখিচুড়ি হিসেবে, আমেরিকাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন যেটা হয়। কিন্তু দল ঠিক করে দেয় কে রাষ্ট্রপতি হবে, এখানে তো সংসদ ঠিক করে কে প্রধানমন্ত্রী হবে। একটা দিতে হয়েছে (সুপারিশ প্রতিবেদন), দিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় সবগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা হওয়া দরকার।“

চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন আসার পরও বিএনপি তাদের গত কয়েক মাসের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করছে। দ্রুত নির্বাচনের উপরই জোর দিচ্ছে দলটি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দিয়েছে। আমরা বারবার যেটা বলেছি, এখনো বলব, যতদ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে অন্তর্বতীকালীন সরকার এগুবে…সেটাই জনগণের প্রত্যাশা, বিএনপির প্রত্যাশা।”

তিনি বলেন, “আমরা সব সময় সংস্কারের পক্ষে, সংস্কারের কথা আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। ২০১৬ সালে আমরাই সংস্কারের লক্ষ্যে ভিশন-২০৩০ দিয়েছি। এরপর ২০২৩ সালে তারেক রহমান সাহেব সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দি্য়েছেন। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া।”

সংস্কার নিয়ে সরকারের ভাবনা

রাষ্ট্র সংস্কারে আসা সুপারিশগুলো নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে কমিশনগুলোকে আরও এক মাস সময় দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে বুধবার চার প্রতিবেদন গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেছেন, “শুধু কাগজ, বই একটা দিলাম, এতে আমাদের কাজ পূর্ণ হল না। আমাদের দায়িত্ব হল এটাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া।

“আপনারা (সংস্কার কমিশন) যেটা বলছেন, তা মানুষ চাচ্ছে না, তা তো নয়। কাজেই এটা মানুষেরই ভাষ্য। ফলে এমন সুন্দরভাবে বলা, যাতে মানুষ এটার মধ্যে এসে যেতে পারে। কেউ নির্বাচনের আগে এসে যাবে, কেউ নির্বাচনের পরে আসবে।”

এরপর বিকালে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এক মাসের মধ্যে আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম হব বলে মনে করি।”

তিনি বলেন, “এই রিপোর্টগুলো নিয়ে কমিশন প্রধানরা বসে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন। কোথায় কোথায় প্রাধান্য দেওয়া হবে, সেই জায়গাগুলো কমিশন প্রধানরা ঠিক করবেন।

“এজন্য আগামীকালকেই একটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছয়টি কমিশনের মেয়াদ আরও একমাস বাড়িয়ে দেওয়া হবে।”

ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি। বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে সরকার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে হাত দেবে।

উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, “যেহেতু কমিশন প্রধানরা স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, এখন সমন্বয়ের কাজটিও তারা স্বাধীনভাবে করবেন। কোন প্রস্তাবগুলোর দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে অর্থাৎ অগ্রাধিকার কী হবে, সেটা ঠিক করা হবে।

“একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু দাবি আছে, অন্যদিকে জনগণের কিছু দাবি আছে, আবার দুই পক্ষের কিছু যৌথ দাবিও আছে। একমাসের মধ্যে আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম হব বলে মনে করি।”

সরকারের ম্যানডেট নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, “প্রেক্ষাপট যেন আমরা ভুলে না যাই, একটা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কিন্তু এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন যদি আমাদেরকে একটা আইনি কাঠামো ধরে কিছু করতে বলা হয়, সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো দেখিয়ে যদি সেই অনুযায়ী কাজ করতে বলা হয়, তখন গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খটা এনডোর্স করা কঠিন হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা গণঅভুত্থানকেই হৃদয়ে ধারণ করেছি এবং সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে এই সংস্কার প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের প্রতিফলন হিসেবেই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো থেকে যতটুকু তারা প্রয়োজন মনে করছেন ততটুকু নিয়েছেন।

“কিন্তু সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনই শেষ করা নয়। এটা নিয়ে আলোচনার আরও প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রয়োজনে চার ধাপে বা তারও বেশি ধাপে আলোচনা করা হবে। এর পরের কমিশনটা হবে পলিটিক্যাল কনসেনসাসের কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই সেই কমিশনের নেতৃত্বে থাকবেন। যা করা হবে, রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতেই হবে।”

সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রস্তাব দিয়েছে, বলেন তিনি।