জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় সভা বৃহস্পতিবার: উপদেষ্টা মাহফুজ
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে জাতীয় ঐক্যে পৌঁছাতে সর্বদলীয় বৈঠকের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার; এরই মধ্যে দলগুলোর কাছে খসড়া পাঠানোও শুরু হয়েছে।
আগামী বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।
এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবি অনুযায়ী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ হওয়ার সুযোগ থাকছে না।
মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, “গত ১২/১৩ দিন ছাত্রদের ঘোষণাপত্র অনুকরণে একটা ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্টেক হোল্ডারদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। সবার সাথে আমাদের কথা বলা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত, নারী সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সাথে, ছাত্রদের সাথে আমরা কথা বলেছি।
”তারা সবাই প্রক্লেমেশনের বিষয়ে একমত আছেন যে ঘোষণাপত্রটি দিতে হবে। কিন্তু ঘোষণাপত্রটি কবে এবং এর ভিতরে কী কী কন্টেন্ট থাকবে সে বিষয়ে আমরা ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। আগামী বৃহস্পতিবার আশা করি সবাই মিলে একটা সর্বদলীয় বৈঠক হবে।”
তার আশা ওই বৈঠকে সবাই এ নিয়ে একমত হতে পারবেন।
মাহফুজ বলেন, “সরকার কীভাবে ঘোষণাপত্রটি জারি করবে সেটা বৈঠকের মাধ্যমে স্পষ্ট হবে। আশা করি বাংলাদেশের জনগণের ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে তাদের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হবে।"
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। গত ২৯ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনে তারা। বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ওই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচিও দেয় তারা।
এ বিষয়ে ২৯ ডিসেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মত অপ্রাসঙ্গিক এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘কবর’ রচনা করা হবে।”
প্রথমে সরকার এর সঙ্গে যুক্ত না হলেও পরে এ প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানায়। তখন ৩১ ডিসেম্বর ঘোষণাপত্র প্রকাশের কর্মসূচি বদল করে সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরে সরকার ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ শুরু করে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা শুরুর কথা বলেছেন উপদেষ্টা মাহফুজ। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই।
এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠকের ঘোষণা এল।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলম মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সেই বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকবে। সেখানে ছাত্রদের নেতৃত্ব থাকবে ৫ অগাস্টের মত। সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও থাকতে পারেন।”
ঘোষণাপত্রে নিয়ে মতামত জানাতে বিএনপি যে সময় চাচ্ছে সেটি নিয়ে তিনি বলেন, “আমরাও চাই এরইমধ্যে সবগুলো রাজনৈতিক দল এটা নিয়ে আলোচনা করুক, এরপর বসুক। বসে কথা বললেই এটা আমরা স্পষ্ট হতে পারব যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এবং কতটুকু যোগ-বিয়োগ করতে হবে। আমরা মনে করি এটা সম্ভব, এটা হয়ে যাবে।”
উপদেষ্টা বলেন, “সরকারের দিক থেকে এই ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট প্রস্তুতের আলোচনা আছে। এটা অনেক আগ থেকে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা মনে করি এটা জনগণের দিক থেকে আগে আসুক। সেটার সূত্র ধরে আমরা করব।”
খসড়া পাঠানো শুরু
ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কয়েকটি দল খসড়া হাতে পাওয়ার কথা স্বীকারও করেছে।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “অন্তবর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাহেবের কাছ থেকে ঘোষণাপত্রের খসড়া পেয়েছি। উনি অনুরোধ করেছেন, এই বিষয়ে আমাদের মতামত জানানোর জন্য।”
তবে মতামত দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় লাগবে মন্তব্য করেন তিনি বলেন, “আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছি। অন্যান্য দল আছে; তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তাদের সঙ্গেও বসতে হবে।”
ঘোষণাপত্রের খসড়া পেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘এখন টিভি’কে বলেন, “সরকার একটা ড্রাফট করছে এবং সেটা আমাদের কাছে পাঠিয়েছে; মতামত চাচ্ছে অফিসিয়ালি। আমরা আলোচনা করেই তা ঠিক করব বলেছি।”
ঘোষণাপত্রের খসড়া পাওয়ার কথা জানিয়েছে জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক জাহিদ আহসান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘোষণাপত্রের খসড়া সরকারই তৈরি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠাচ্ছে। আমাদের কাছেও তা পাঠিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে।
“আমরা গত কয়েক দিন সারা দেশে লিফলেট বিতরণ করেছি। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাটা কী, তা জানার চেষ্টা করেছি। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন আমাদের মতামতে থাকবে।”
ঘোষণাপত্র হাতে পেয়েছে গণ-অধিকার পরিষদ। দলের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এই ঘোষণাপত্রের খসড়াটা আগেও পেয়েছিলাম, এখন আবার পেয়েছি।”
ঘোষণাপত্রে কী থাকছে?
খসড়া ঘোষণাপত্র হাতে পেলেও তাতে কী আছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়নি দলগুলো। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিএনপি ও সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে কিছু আভাস মিলেছে। এর মধ্যে বাহাত্তরের সংবিধান কাটছাটের বিষয়টিও আছে।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, “এই ঘোষণাপত্রের (খসড়া) মধ্যে সংবিধানের ব্যাপারে বহু কথা আছে, যেগুলো আমাদের দেখতে হবে। সুতরাং আমাদের কিছুটা সময় (মতামত দিতে) লাগবে আরকি।”
ঘোষণাপত্রে ‘জুলাই বিপ্লবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি’, ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’, ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ’সহ রাষ্ট্র পরিচালনার নানা নির্দেশনা থাকবে। ঘোষণাপত্র দুই থেকে তিন পৃষ্ঠার হবে বলেও আভাস মিলেছে।
গেল বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মাহফুজ বলেন, “এর দুটো দিক থাকে। সেট হল কী কারণে করছি এবং কী চাচ্ছি। আমরা এ কারণে ঘোষণাপত্র চাচ্ছি যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই বিষয়ে ঐকমত্য আছে। ঘোষণাপত্রের দ্বিতীয় ভাগে থাকবে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে।”
বিএনপির দাবি, ঘোষণাপত্র শুধু জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দিলে হবে না। বিএনপির বিগত দেড় দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিফলনও তাতে থাকতে হবে।
এ বিষয়ে মাহফুজ বলেন, “বিএনপি বলেছে তাদের ১৬ বছরের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের স্বীকৃতি হোক। শুধু তাদের নয়, যত রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন বা ব্যক্তি বিশেষের সংগ্রামের ইতিহাস আছে, সবার কথাই ঘোষণাপত্রে থাকবে।”
“ঘোষণাপত্র আসবে সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সরকার বানিয়ে কোনো ঘোষণাপত্র দেবে না। শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব ও সবার ঐকমত্যে ঘোষণাপত্র আসবে।”
“সংবিধানের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব আছে। আবার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সে প্রস্তাব নিয়ে বিরোধিতাও আছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য আছে, তা আমরা লিপিবদ্ধ করব। সংবিধান সংস্কার হবে না কি বাতিল হবে, সেই সিদ্ধান্ত আলোচনার ভিত্তিতেই নেওয়া হবে।”