বুধবার ০১ জানুয়ারি ২০২৫, পৌষ ১৮ ১৪৩১, ০১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

সচিবালয়ে আগুন: ‘গাফিলতি’ ছিল অগ্নিনিরাপত্তায়, ‘মানা হয়নি’ সুপারিশ

 প্রকাশিত: ১২:২১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সচিবালয়ে আগুন: ‘গাফিলতি’ ছিল অগ্নিনিরাপত্তায়, ‘মানা হয়নি’ সুপারিশ

সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ২০১৯ সালের শেষ দিকে পরীক্ষা করে দেখেছিল ফায়ার সার্ভিস। কয়েকটি ভবনের বিভিন্ন ঝুঁকি চিহ্নিত করে ২০২০ সালে বেশকিছু সুপারিশও করেছিল। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সেসব সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি। উল্টো সহজে আগুন ধরে যায় এমন উপাদান দিয়ে বিভিন্ন ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে।

বুধবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। অর্ধশত বছরের পুরোনো ওই ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাও ভালো না ছিল না।

রাত ১টা ৫২ মিনিটে আগুনের খবর পেয়ে সেখানে যায় ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট। আ্গুন পুরোপুরি নেভাতে বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১২টা বেজে যায়।

আগুনে সাত নম্বর ভবনের ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে যায়।

এসব ফ্লোরে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি দপ্তর।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা সেদিন বলেছিলেন, সচিবালয়ের প্রবেশপথ দিয়ে অগ্নিনির্বাপনের গাড়ি ঢুকতে বেগ পেতে হয়েছিল। সেখানে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় বাইরে থেকে আনতে হয়েছে পানি। তাতে আগুন নেভাতে সময় লেগেছে বেশি।


সচিবালয়ের পুরোনো ভবনগুলোর মধ্যে ৭ নম্বর একটি। এই ভবনটি নির্মাণ হয় ষাটের দশকে। পুরোনো ভবন সংস্কার করে সাজসজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ, প্লাইউডসহ দাহ্য বস্তু।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিবেচনায় সচিবালয়ের ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা যাচাই-বাছাই করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কয়েকবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল।

“তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা হয়নি। তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি, এখানে শতভাগ গাফিলতি ছিল।”

দেবাশীষ বর্ধন বলেন, তিনি ২০২৩ সালের শেষ দিকে অবসরে গেছেন। বিদায়ের আগেও তিনি সচিবালয়ের ভবনগুলো ‘অনিরাপদ’ দেখে গেছেন।

সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, “আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ নম্বর ভবনটি অনেক পুরোনো। ওই ভবনের বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং অনেক পুরাতন ছিল। প্রতিটি কক্ষে ফলস সিলিং দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। ওই ভবনে ফায়ার হাইড্রেন্ট ছিল না।”

আগুন নেভানোর সময় ট্রাকচাপায় ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো. সোয়ানুর জামান নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় আক্ষেপ করেন দেবাশীষ বর্ধন।

তিনি বলেন, “সেখানে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থাকলে ফায়ারম্যান ছেলেটিকে পানির পাইপ নিয়ে দৌড় দিয়ে মরতে হত না। আন্ডারগ্রাউন্ডে যদি রিজার্ভ থাকত, হাইড্রেন্ট যদি থাকত, তাহলে বাইরে থেকে পানি আনার প্রয়োজন পড়ত না। সচিবালয়ের মত জায়গায় এগুলা কেন থাকবে না? হাজার কোটি টাকা খরচ করছে, এগুলা কেন করবে না?”

দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সচিবালয়ের ভেতরে একটি পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশন করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার বদলে কেবল ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সচিবালয়ের উত্তর দিকের প্রবেশপথ বড় করার পরামর্শও ফায়ার সার্ভিসের তরফে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো সহজে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছু ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল। তাও পর্যাপ্ত ছিল না, নির্ধারিত দূরত্বে যে পরিমাণ থাকা প্রয়োজন, সে পরিমাণ আমরা তখন পাইনি। আমরা চিঠি দিয়ে প্রতিটি বিষয় অবহিত করার পরও কিছুই করা হয়নি।”

অগ্নিকাণ্ডের সময় দশ তলা ওই ভবনের উপরের দিকের একটি ফ্লোর এমাথা-ওমাথা জ্বলতে দেখা যায়। এ অগ্নিকাণ্ডের কারণে নিয়ে অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সন্দেহ প্রকাশ করেন। সরকারের দুজন উপদেষ্টাও ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা বলেন।

এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে দেবাশীষ বর্ধন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্লেষণ করে বলেন, “এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়ে গেছে, তারা নিশ্চয় বলবে। কিন্তু একসঙ্গে তিন-চার জায়গায় আগুন লাগার বিষয়টি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। যেহেতু এটা দীর্ঘ দিনের পুরাতন ভবন, শট সার্কিট থেকেও হতে পারে। কারণ বৈদ্যুতিক তারগুলোও একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পরীক্ষা করতে হয়। বিদ্যুতের আগুন হলেও আলামত থাকবে। নাশকতা হলে কেমিকেল টেস্টে বের হবে। পুলিশ নিশ্চয় আলামতগুলোর ল্যাব টেস্ট করবে।”

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েল জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। কাজ শুরুর পর শুক্রবার পোড়া ভবনটি পরিদর্শন করেন কমিটির সদস্যরা।

কমিটির সদস্য সচিব ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, "অগ্নিকাণ্ড নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা এ বিষয়ে মন্তব্য করার মত অবস্থা হয়নি। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসেছি। বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি, তদন্ত সাপেক্ষে বাকি কথা বলা যাবে।"

সচিবালয়ের ভবনগুলোর নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করছে গৃহায়ন ও গণপুর্ত মন্ত্রণালয়ের গণপূর্ত অধিদপ্তর। সচিবালয়ে ভবনের পুর কাজ দেখে গণপূর্তের ইডেন ভবন বিভাগ, আর বৈদ্যুতিক এবং অগ্নিনিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব ইঅ্যান্ডএম বিভাগ-৪ এর।

ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তার নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশের বাস্তবায়ন কেন করা হয়নি জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইঅ্যান্ডএম বিভাগ-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়াজ মো. তানভীর আলম শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যোগ দিয়েছি তিন মাস হল। সে কারণে আগের বিষয়টি জানি না। এই কয়দিন আমাদের অফিসও বন্ধ ছিল। অফিসে গিয়ে ফাইল দেখে জানাতে পারব আসলে তারা কী সুপারিশ করেছিলেন।”

ইডেন ভবন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুস সাত্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বিভিন্ন ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরের বেশিরভাগের সাজসজ্জা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী করা হয়েছে।

“আমাদেরকে মিনিস্ট্রি থেকে কখনো বলেনি যে সাজসজ্জা করা যাবে না। আমরা ডেকোরেশন করি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী, তারা যেভাবে চাহিদা দেন আমরা সেভাবে করে দিই। মন্ত্রণালয় থেকে যদি বলে দেয় এভাবে করা যাবে না, তাহলে আমরা করব না।”