বুধবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ১০ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা

 প্রকাশিত: ১২:৩২, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

রোববার দুপুরে উপজেলার কুলিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে হেনস্তার শিকার আব্দুল হাই কানু জানিয়েছেন।

ওই ঘটনার ১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সেদিন রাতে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এমনকি সোমবার খোদ প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওেয়া হয়।

চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এটিএম আক্তারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যারা লাঞ্ছিত করেছে, তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।”

৭৮ বছর বয়সী আব্দুল হাই কানুর বাড়ি চৌদ্দগ্রামের বাতিসা ইউনিয়নের লুদিয়ারা এলাকায়। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হেনস্তাকারীরাও একই এলাকার বাসিন্দা।

স্থানীয়রা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা কানু কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মুজিবুল হকের রোষানলে পড়ে বিগত ৮ বছর এলাকায় যেতে পারেননি। বাড়িঘরে হামলা করাসহ একাধিক মামলা দেওয়া হয় ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে।

রোববার দুপুরে বাড়ির পাশের গ্রামে তাকে একা পেয়ে স্থানীয় অন্তত ২০ জন ব্যক্তি তাকে হেনস্তা করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। পরে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। তাদেরই একজন ঘটনার ভিডিও করে।

ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধার কানুর হাত টেনে সামনে নিয়ে যাচ্ছেন। কানুর গলায় রশি দিয়ে বাধা কয়েকটি জুতা দেখা যায়। তার আশপাশে ঘিরে ছিল আরো জনা পনের লোক।

একপর্যায়ে কানু জুতার মালা সরিয়ে এলাকায় থাকার আকুতি জানালেও তাকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিতে থাকেন ঘিরে থাকা লোকজন।

ওই ব্যক্তিদের একজনকে বলতে শোনা যায়– “এক গ্রাম লোকের সামনে মাফ চাইতে পারবেন কি না?” তখন কানুকে দুই হাত উপরে তুলে মাফ চাইতে দেখা যায়।

ঘটনার পর অসুস্থ অবস্থায় ওই মুক্তিযোদ্ধাকে ফেনীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “স্থানীয় জামায়াত সমর্থক প্রবাসী আবুল হাসেমের নেতৃত্বে অহিদ, রাসেল, পলাশসহ ১০ থেকে ১২ আমাকে একা পেয়ে জোর করে জুতার মালা গালায় দিয়ে ভিডিও করে। আমি বিগত সময়ে তাদের কোনো ক্ষতি করিনি৷”

চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তারুজ্জামান বলেন, “ঘটনার পর ওই মুক্তিযোদ্ধা মোবাইল ফোনে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছিলেন। তবে এ বিষয়ে তিনি লিখিত অভিযোগ করবেন না বলেও জানিয়েছেন। রাতে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার আবারও তাকে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে।”

“আমরা ঘটনায় জড়িতদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ করছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অভিযোগ কেন দিতে চাইছেন না– এই প্রশ্নে আব্দুল হাই কানু বলেন, “বিচার কার কাছে চাইব, মামলা দিয়ে আর কী হবে? এমন বাংলাদেশের জন্যই কি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম?”

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই আবুল হাসেম বা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকম।

তাদের জামায়াত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন করলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমির মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, “আমরা খোঁজ নিচ্ছি৷ জামায়াতের কেউ জড়িত থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সফিউল আলম বাবুল বলেন, “এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। আবদুল হাই কানু স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তাকে যারা এভাবে লাঞ্ছিত করেছে, তাদের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছি।”

এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার না করা হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও জানিয়েছেন তিনি।

কুমিল্লার মানবাধিকার সংগঠক আলী আকবর মাসুম বলেন, “কোনো একজন মানুষকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপমান বা হেও প্রতিপন্ন করার অধিকার কারো নেই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রেতো সেটার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের দেশে এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা শুধু আমাদের স্বাধীনতাই দেননি, আজীবন ত্যাগ শিকার করে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন, যাচ্ছেন।

“যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা সমাজে অপরাধী হিসেবেই বিবেচিত। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এমন উদাহরণ আরও হতেই থাকবে।”