মঙ্গলবার ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ১০ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হাতেখড়ি বিজয়ের দিনে

 প্রকাশিত: ১৮:৩৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হাতেখড়ি বিজয়ের দিনে

“মুক্তিযুদ্ধ কী? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? ১৬ ডিসেম্বরই বা কী? বাচ্চাকাচ্চাকে তো বোঝাতে হবে এসব। সেজন্যই আসা।”

বিজয় দিবসের সকালে ছয় বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে সাভারের স্মৃতিসৌধে নিয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা করছিলেন কুরগাঁও এলাকার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন মিলন।

মিলনের মত বহু নারী-পুরুষ সোমবার ভোরে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন স্মৃতিসৌধে। ১৬ ডিসেম্বর কেন বাঙালির মুক্তির দিন, বিজয়ের দিন, চেতনার দিন, সেই পাঠ তারা ছেলেমেয়েদের দিয়েছেন।

১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় আসার এই দিনটি উদযাপন করতে রাজধানীসহ সারা দেশেই দিনভর ছিল নানা আয়োজন।

রাজধানীসহ আশপাশের মানুষের জন্য বরাবরের মত এবারও উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

পৌষের প্রথম সকালে শীত উপেক্ষা করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশের অপেক্ষা করছিলেন হাজারো জনতা। ভোরের আলো ফুটতেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশে সফররত পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস।


তাদের আগমন ঘিরে চারপাশে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। তারা চলে যেতেই হাজারো মানুষের স্রোত ঢুকে পড়ে স্মৃতিসৌধে। মুহূর্তে যেন বিজয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

নারীদের কেউ এসেছিলেন লাল-সবুজ শাড়িতে সেজে, পুরুষদের কেউ কেউ পরেছেন পাঞ্জাবি। লাল-সবুজের আধিক্য ছিল শিশুদের পোশাকেও।

কারো কপালে ছিল লাল-সবুজের টিপ; কারো মাথার লাল-সবুজের পতাকা; কপালেও বেঁধেছেন কেউ কেউ। লাল-সবুজের ফুলগাছগুলোও তাদের সঙ্গে মিশে যায়।

আশুলিয়ার খেজুরবাগান এলাকা থেকে বন্ধুর সঙ্গে স্মৃতিসৌধে এসেছিলেন মোহাম্মদ জাকিরুল ইসলাম; পেশায় তিনি নির্মাণ শ্রমিক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে যারা মারা গেছেন, তাদের জন্য দোয়া করতে এসেছি। এখানে এলে তাদের কথা মনে পড়ে; তাদের জন্য হৃদয় কাঁদে। যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করি।”

বাবা চাকরিসূত্রে থাকেন সাভারে। ছোট্ট আবদুল্লাহ আল সিয়াম থাকে রংপুরে। ছুটির দিনে বাবা তাকে নিয়ে এসেছেন স্মৃতিসৌধে।

সেই গল্প তারা বাবা শোনালেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার পরিবার থাকে রংপুরে। বিজয় দিবসের যে আমেজ, সেটা সেখান থেকে খুব একটা উপলব্ধি করা যায় না। তাছাড়া ছেলেটাও জানল, স্মৃতিসৌধটা আসলে কোথায়।

“এই সৌধের সঙ্গে যে নানা ইতিহাস জড়িয়ে আছে, সেটা দেখল। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, সেটার বোঝার হাতেখড়ি হলো আজ।”

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ মধ্য দিয়ে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। শুধু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৬ ডিসেম্বর।

সেদিন ঢাকার রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর তাই বাঙালির বিজয় দিবস।

সাভারের পল্লীবিদ্যুৎ এলাকার বাসিন্দা কৃপা চাকমা স্মৃতিসৌধে এসেছিলেন নিজের ছোট সন্তান আর মাকে নিয়ে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক মানুষের সমাগম; খুবই ভালো লাগছে। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। আজ মুক্তির দিন, আনন্দের দিন।”

দুপুরের পর ধীরে-ধীরে ভিড় কমতে শুরু করে।

বিজয় দিবসে সরকারি ছুটির দিনে দেশের সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলোয় করা হয় আলোকসজ্জা। সাজানো হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ।

এছাড়া, দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করে।

দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দিনব্যাপী হয় বিজয়মেলা। শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ।

চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পাগলা (নারায়ণগঞ্জ) ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে, চাঁদপুর ও মুন্সিগঞ্জ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

এছাড়া দেশের সব শিশু পার্ক ও জাদুঘর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় এবং সিনেমা হলে করা হয় বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা।