বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ৫ ১৪৩১, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী ম্রোরা পড়বে নিজের ভাষায়

 প্রকাশিত: ১৫:২০, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী ম্রোরা পড়বে নিজের ভাষায়

বাঙালির গৌরব, আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার প্রতীক সাত বীরশ্রেষ্ঠর অবদান ম্রো জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরতে, তাদের জীবনী নিয়ে লেখা বই পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষা ম্রো বর্ণমালায় প্রকাশিত হয়েছে।

বইটির লেখক বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের বাইট্যা পাড়ার বাসিন্দা ম্রো ভাষার লেখক ইয়াংঙান ম্রো। তিনি বলেন, “একটা দেশের জন্য তাদের অবদানের কথা আমরা জানি না। আমাদেরও জানা দরকার। কিন্তু বাংলায় লেখা হওয়ার কারণে জানার সুযোগ নেই। তখন থেকে এই সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে ম্রো ভাষায় লেখার ইচ্ছা পোষণ করি।”

একাত্তরের রণাঙ্গণে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন দেখানোর স্বীকৃতিতে শহীদ সাত মুক্তিযোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হয়। বীরশ্রেষ্ঠ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব।

ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ, শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমান, শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল, শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান, শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ, শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠ।

তাদের নিয়ে ২০১৭ সালে থেকে প্রায় সাত বছর ধরে ম্রো ভাষায় লেখা ২৪ পৃষ্ঠার বইটির মোড়ক উন্মোচন হয় রোববার সকালে বান্দরবান শহরের উজানি পাড়ার একটি রেস্তোরাঁয়। মোড়ক উন্মোচন করেন সুয়ালক ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়য়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক চিত্তরঞ্জন জলদাস।

একই সময় ম্রোদের ‘ক্রামা ধর্ম’ প্রবর্তক মেনলে ম্রো’র আঁকা ছবির অ্যালবামের মোড়কও উন্মোচন করা হয়েছে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের’ নির্বাহী পরিচালক মং মং সিং মারমা, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা-গ্রাউসের উপ-নির্বাহী পরিচালক চিন্ময় মুরুং ও লেখক রিপন চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ইয়াংঙান ম্রো’র ৩৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে ম্রো ভাষায় লেখা ২১টি, বাংলায় লেখা ১১টি, বিলুপ্তপ্রায় ‘রেংমিটচ্য ভাষার’ শব্দভাণ্ডার নিয়ে ম্রো ও বাংলায় লেখা একটি।

সুয়ালক ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক চিত্তরঞ্জন জলদাস বলেন, “যে কোনো ভাষা ও সংস্কৃতি তার জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে। আগে ম্রোদের কোনো অক্ষর বা বর্ণমালা ছিল না। হয়ত অনেকেই চেষ্টা করেছেন, পারেননি। একদিন সুয়ালক ম্রো আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ‘মেনলে ম্রো’ নামে একটা ছেলে হঠাৎ ক্লাসে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি ম্রো ভাষার বর্ণমালা তৈরি করব।”

“ওই সময় থেকে মেনলে ম্রোর মধ্যে একটু ধ্যানী ভাব ছিল। এরপর স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এখন পর্যন্ত নিরুদ্দেশ তিনি। পরে সত্যিই তিনি ম্রো বর্ণমালা সৃষ্টি করে গেছেন। এখন এই ম্রো ভাষার বর্ণমালা দিয়ে বই লেখা হচ্ছে। বই প্রকাশিত হচ্ছে। এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার।’’

লেখক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, “ম্রোদের বেশির ভাগ লোকজন এখনও বাংলা পড়তে পারে না। কিন্তু নিজেদের ম্রো ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারে। একদিন দেখলাম, একজন ম্রো সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে একটি বাংলা বই নড়াচড়া করে দেখছে। এরপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ম্রো ভাষায় বইটি লেখা শুরু করি।”

এর আগে বিলুপ্তপ্রায় ‘রেংমিটচ্য’ ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে ইয়াংঙানের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় ‘মিটচ্য তখক’ নামের এই বইটিতে রেংমিটচ্য ভাষার উচ্চারণ ম্রো শব্দের পাশাপাশি লেখা হয়েছে বাংলা শব্দের মাধ্যমে। ২০১৩ সালে থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে রেংমিটচ্য ভাষার শব্দ সংগ্রহ করে তিনি বইটি প্রকাশ করেন।

সাত বীরশ্রেষ্ঠর জীবনী লিখতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যভাষা (পালি) বিভাগের সাবেক এ ছাত্র সময় নিয়েছেন সাত বছর। এ প্রসঙ্গে ইয়াংঙান বলছিলেন, “আসলে একটানা কাজ করা হয় না। একটানা কাজ করলে হয়ত এত সময় লাগত না।

“বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে যেসব লেখা পড়েছি, অনেক বাংলা ভাষার অর্থ জানা ছিল না। ফলে ম্রো ভাষায় ভাষান্তর করতে অনেক সিনিয়দের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে হয়েছে। এই বইয়ে মোট ২৪ পৃষ্ঠা আছে।”

বইয়ের নামকরণ প্রসঙ্গে ইয়াংঙান ম্রো বলেন, বইটির নাম ম্রো ভাষায় রাখা হয়েছে ‘নমমো তসেন কিয়াক মি’। বাংলার অর্থ ‘যুদ্ধের মধ্যে সেরা’। ম্রো ভাষায় বীরশ্রষ্ঠ নামে সরাসরি কোনো শব্দ নেই।”

কে এই মেনলে ম্রো

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার ম্রো সম্প্রদায় ১১টি পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। বান্দরবানের নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এরা জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয়।

ম্রো সম্প্রদায় সাধারণত ম্রুং, ম্রো নামেও পরিচিত হয়ে থাকে। তাদের পরিচয় ম্রো হলেও বাংলাদেশে তারা ম্রুং/ মুরং নামেও পরিচিত।

ম্রো পাড়া গ্রামটি চিম্বুক পাহাড়ে ঘেঁষা। বান্দরবান শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের সুয়ালক ইউনিয়নের এই গ্রামেই ১৯৬৫ সালে মেনলে ম্রোর জন্ম, যা এখন ‘ক্রামাদি পাড়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

সেখানে থাকা অবস্থায় আরও কঠোর ধ্যান করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মেনলে ম্রো হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাকে ঘিরে ম্রো সমাজে নানা রকম কিংবদন্তী রয়েছে। তাদের বিশ্বাস, ভবিষ্যতে একদিন আবার ফিরে আসবেন তিনি।

ইয়াংঙান ম্রো বলেন, আশির দশকে মেনলে ম্রো ‘ক্রামা’ ধর্মটি প্রবর্তন করেন। ‘ক্রামা’ অর্থ অসীম জ্ঞানের অধিকারী। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখার গণ্ডি শেষ করা মেনলে ছোটবেলাই ‘ব্যতিক্রম’ ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞানও ছিল তার। লেখাপড়া ছেড়ে তিনি মাসের পর মাস ধ্যান করতেন বটগাছের নিচে। পরবর্তীতে ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য ধ্যানের মাধ্যমে পাওয়া ‘ক্রামা ধর্ম’ নামে একটি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন।

“সেই সঙ্গে তৈরি করেন এই ধর্ম পালনের জন্য বিভিন্ন নিয়ম ও রীতিনীতি। এ ধর্ম প্রবর্তনের পাশাপাশি সেই সময় তিনিই প্রথম রচনা করেন ম্রো ভাষার বর্ণমালা। পরে শিষ্য তৈরি করে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় ম্রো বর্ণমালা ও ক্রামা ধর্ম প্রচারণা চালাতেন।”

মেনলে’র আঁকা ছবি নিয়ে প্রকাশিত অ্যালবাম প্রসঙ্গে ইয়াংঙান বলেন, ম্রো ভাষায় নিজস্ব ‘বর্ণমালা’ ও ‘ক্রামা ধর্ম সৃষ্টি করে গেছেন মেনলে ম্রো। ১৯৮২ সালে তার আঁকা ছবি বিভিন্নজনের কাছে ছিল। কোনটা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। আবার কোনটা অস্পষ্ট ও ঝাপসা ছিল।

“সেসব ছবি ১৭ বছর ধরে সংগ্রহ করেছি। মোট ২৩টা ছবি পেয়েছি। অ্যালবামে ছবির সঙ্গে বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে।”

‘ক্রামা ধর্ম’ প্রবর্তনের আগে পাহাড়ে জুমচাষ করে আসা এই ম্রো জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ ছিলেন প্রকৃতি পূজারী। এর বাইরে এখনও কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছে।

২০২১ সালে করা গৃহগণনা ও জনশুমারী তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ম্রো জনসংখ্যা ৫১ হাজার ৪৪৮ জন।

কিন্তু সামাজিক সংগঠন ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের সহসভাপতি খামলাই ম্রোর দাবি, ২০০৫ সালে নিজেদের করা জরিপে তাদের জনসংখ্যা ৬৭ হাজার ৩৭৬ জন পাওয়া গিয়েছিল।