রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, পৌষ ১ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ব্রেকিং

গ্রেপ্তার অভিযান আরো জোরদার করা হবে: আসিফ মাহমুদ দেশকে আরও উন্নত ও স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল ভোগ করতে আমরা বদ্ধপরিকর : প্রধান উপদেষ্টা ভবিষ্যতে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা কমানো হবে: অর্থ উপদেষ্টা বেনজীর ও মতিউর পরিবারের বিরুদ্ধে ৬ মামলা ‘কয়েকজন’ বিচারপতির বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রতিবেদন রাজনৈতিক মঞ্চে সশরীরে আসছেন খালেদা জিয়া ভোট ‘চুরিতে’ জড়িত কর্মকর্তাদের বিচার চায় বিএনপি মহার্ঘ্য ভাতা সব সরকারি কর্মচারী পাবেন: জনপ্রশাসন সচিব রাষ্ট্রের সংস্কার কখনো রাজনীতিবিদদের অবসর দিয়ে হয় না: রিজভী ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী নদীসহ চার জন রিমান্ডে মানহানির মামলায় এবিসি নিউজ থেকে দেড় কোটি ডলার পাচ্ছেন ট্রাম্প

জাতীয়

বেনজীর ও মতিউর পরিবারের বিরুদ্ধে ৬ মামলা

 আপডেট: ১৮:৪৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বেনজীর ও মতিউর পরিবারের বিরুদ্ধে ৬ মামলা

‘অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের’ অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপদির্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন রোববার বিকেলে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

ছয় মামলার মধ্যে বেনজীর, তার স্ত্রী জিসান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে চারটি মামলা করা হয়েছে।

বাকি দুটি মামলা হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রেসিডেন্ট মতিউর এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর বিরুদ্ধে।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, ছয় মামলায় মোট ৮৫ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এর মধ্যে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায় ৭৫ কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। আর মতিউর ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের কথা বলা হয়েছে মামলায়।

প্রথম মামলা আসামি হয়েছেন বেনজীর আহমেদ। তার বিরুদ্ধে ৯ কোটি ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫১ টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ মালিক হওয়ার এবং ২ কোটি ৬২ লাখ ৮৯ হাজার ৬০ টাকার ‘সম্পদের তথ্য গোপনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

দ্বিতীয় মামলায় আসামি হয়েছেন বেনজীর ও তার স্ত্রী জীসান মির্জা। জীসান মির্জার বিরুদ্ধে ৩১ কোটি ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৯ টাকার ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন’ এবং ১৬ কোটি ১ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৬ টাকার সম্পদের ‘তথ্য গোপনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই সম্পদ তিনি তার স্বামী বেনজীর আহমেদের ‘অবৈধ আয়ের মাধ্যমে অর্জন করেছেন’ বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

তৃতীয় মামলায় বেনজীর ও তার মেয়ে ফারহিন রিশতা বেনজীরকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় রিশতার বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৭৫ লাখ ২৭৪ টাকার ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

চতুর্থ মামলায় আসামি হয়েছেন বেনজীর এবং তার মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর। তার বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫ টাকার ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

এদিকে মতিউরের বিরুদ্ধে এক মামলায় ৫ কোটি ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৯ টাকার ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ’ অর্জন এবং ১ কোটি ২৭ লাখ ৬৬ হাজার ২১৬ টাকার ‘সম্পদের তথ্য গোপনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

দ্বিতীয় মামলায় মতিউরের সঙ্গে আসামি হয়েছেন তার স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী। তার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৮৭ লাখ ১৫ হাজার ৪৯০ টাকার ‘অবৈধ সম্পদ’ এবং ২ কোটি ৭৫ লাখ ২৮ হাজার ৪৭৫ টাকার ‘সম্পদের তথ্য গোপনের’ অভিযোগ আনা হয়েছে।

‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’

বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ প্রধান, যিনি একাধারে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ ইউনিট র‌্যাবেরও প্রধান ছিলেন। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি অবসরে যান।

গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে তাকে নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক কালের কণ্ঠ। সেখানে সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠে আসে। এরপর আলোচনা শুরু হয় তাকে নিয়ে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে প্রায় ১৪০০ বিঘা জমিতে একটি ইকো রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন বেনজীর পরিবার। এছাড়া ঢাকা ও পূর্বাচলে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে।

তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়ার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে সেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

বনের জমি দখল করে গাজীপুরে রিসোর্ট বানানোর অভিযোগও আনা হয়েছে দৈনিকটির আরেক প্রতিবেদনে। ওই রিসোর্টের এক-চতুর্থাংশের মালিকানা বেনজীর পরিবারের বলে পত্রিকাটি দাবি করেছে।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে হবিগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন (বর্তমানে সাবেক) এপ্রিলের শেষে বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে আবেদন করেন।

এরপর ২২ এপ্রিল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, বেনজীরের ‘অবৈধ সম্পদ’ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। এজন্য তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন- উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক নিয়ামুল হাসান গাজী এবং জয়নাল আবেদীন।

একই দিন এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে বেনজীরের বিষয়ে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন চেয়ে নির্দেশ দেয় হাই কোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী এবাদাত হোসেনের বেঞ্চ।

নির্দেশনার পর সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর ও তার পরিবারের সম্পদের খোঁজে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আটটি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক।

পরে দুদকের আবেদনে বেনজীর, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। সেই সঙ্গে তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ারও অবরুদ্ধ করার আদেশ আসে। সেই অনুযায়ী পরে ব্যবস্থাও নেয় দুদক।

বেনজীর ও তার স্ত্রী-কন্যাদের দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে বোট ক্লাবের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগের জন্য দেওয়া চিঠিতে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিদেশে থাকার কথা বলেন। তারা সবাই দেশের বাইরে চলে গেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে।

ছাগলকাণ্ডে ধরা মতিউর

বেনজীরের সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান শুরুর আলোচনার মধ্যে কোরবানি ঈদের সময় ‘ছাগলকাণ্ডের’ ঘটনায় আলোচনায় আসেন একাদশ বিসিএসের (শুল্ক ও আবগারি) কর্মকর্তা মতিউর রহমান।

এরপর তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে যুক্ত করা হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনীত পরিচালক পদ থেকেও।

সংবাদমাধ্যমে একের পর এক মতিউর, তার স্ত্রী ও সন্তানের সম্পদের খবর আসার মধ্যে দুদক তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।

এরপর তার দেশত্যাগের আলোচনার মধ্যে আদালত মতিউর, তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়।

ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবি জুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন- ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?

এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান।

ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হল কী করে?

অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষপর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটির তিনি আর নিয়ে যাননি।

বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।

মতিউর রহমান এ আলোচনায় ঘি ঢালেন ছেলের পরিচয় ‘অস্বীকার’ করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান।

এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়।

এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা।

এ সংসদ সদস্য বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনি এখন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

মতিউর রহমান এর আগে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনার সহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।