শাহজালালে দুই লাউঞ্জ নিয়ে প্রবাসীদের সন্তোষ, রয়েছে প্রচারের অভাব
প্রায় ২২ বছর ধরে ইতালির মিলান শহরে থাকেন নোয়াখালীর সেনবাগের সাইদুল ইসলাম। সোমবার সকালে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে স্বজনদের খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের কোনো সিম কার্ডও ছিল না। শেষে ইমিগ্রেশনে ‘প্রবাসী লাউঞ্জে’ গিয়ে ফোন করে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ মেলে তার।
ফোনে সাইদুল জানতে পারেন, পরিবারের সদস্যদের বিমানবন্দরে পৌঁছতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। তখন অপেক্ষার সময়টুকু ওই লাউঞ্জে বসেই কাটিয়ে দেন এ প্রবাসী।
রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নভেম্বরে উদ্বোধন হয়েছে দুটি লাউঞ্জ। এর একটি প্রবাসীদের জন্য নির্মিত বিশেষায়িত ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’। অন্যটি ‘ওয়েটিং লাউঞ্জ’, যেটি তৈরি করা হয়েছে যাত্রী ও অপেক্ষমান স্বজনদের জন্য।
প্রবাসীদের জন্য বানানো লাউঞ্জটির অবস্থান বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের ভেতরে; ইমিগ্রেশন যেখানে সম্পন্ন হয়, সেখানে। ওয়েটিং লাউঞ্জটি করা হয়েছে ২ নম্বর টার্মিনাল ঘেঁষে বানানো বহুতল কার পার্কিং ভবনের দ্বিতীয় তলায়।
যাত্রী ও তাদের স্বজনদের অনেকেই এখনো লাউঞ্জ দুটি সম্পর্কে জানেন না। যারা জানেন, তাদের বেশিরভাগই লাউঞ্জ দুটি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সোমবার দেখা যায়, ওয়েটিং লাউঞ্জে অনেকেই অবস্থান করছেন। লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তায় রয়েছেন বিমানবাহিনী, আনসার এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা।
ওয়েটিং লাউঞ্জের ভেতরে রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা, নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা নামাজের জায়গা, প্রক্ষালন কক্ষ, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফে ও মাতৃদুগ্ধ পান কেন্দ্র।
সময় কাটনোর জন্য আছে টেলিভিশনের ব্যবস্থা। দুটি আলাদা মনিটর বসানো হয়েছে, যেগুলোয় ফ্লাইটের তথ্য জানা যায়।
ব্যবহারকারীরা বলছেন ‘ভালো উদ্যোগ’
মানিকগঞ্জের বাসিন্দা সোহেল রানা। প্রায় ৮ বছর সিঙ্গাপুরে কাটিয়ে দেশে এসেছেন কয়েক মাস আগে। সোমবার আবার সিঙ্গাপুরে রওনা হন। তার ফ্লাইট ছিল সকালে। সেটি মিস করেছেন। তাকে দুপুর ১২টায় পাওয়া গেল ওয়েটিং লাউঞ্জে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে যখন বিমানবন্দরে এসেছি, তখন অপেক্ষা করার মত কোনো জায়গা পাইনি। এখন লাউঞ্জটা হওয়ায় খুব ভালো হল। নয়ত আমার লাগেজগুলো নিয়ে খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হত।”
লাউঞ্জে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাসিন্দা শফিকুল মল্লিক। যাবেন ওমানে; ফ্লাইট বিকাল ৪টায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খুবই সুন্দর ব্যবস্থা এখানে। পরিবারের সঙ্গে একটু আরামে সময় কাটানোর সব ব্যবস্থাই আছে। সত্যি বলতে কি, দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে এবার খুব একটা মন খারাপ লাগছে না।”
ঠাকুরগাঁওয়ের রানিশংকৈল এলাকার বাসিন্দা শাইরুল ইসলাম এসেছেন ভগ্নিপতিকে এগিয়ে দিতে। ভগ্নিপতির ফ্লাইট রাত ১০টায়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা আগেই বিমানবন্দরে চলে আসায় ওয়েটিং লাউঞ্জে সময় কাটান তারা।
শাইরুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি নিজেও ১০ বছর মালয়েশিয়ায় ছিলাম। এ সেবা আগে ছিল না। উদ্যোগটা অনেক ভালো হয়েছে। নয়ত আমাদের নিশ্চিত হোটেলে উঠতে হত। হোটেলে আবার মালামাল নিয়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ, প্রতারিত হওয়ার নানা ফাঁদ থাকে।”
অনেকেই জানেন না
প্রবাসী লাউঞ্জ বা ওয়েটিং লাউঞ্জ সম্পর্কে এখনও জানেন না বিমানবন্দর ব্যবহারকারী অনেকেই। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সে তথ্য।
স্বামীকে বরণ করতে ফুল হাতে বিমানবন্দরের দুই নম্বর টার্মিনালের ক্যানোপিতে অপেক্ষা করছিলেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার সুমনা আক্তার। কিন্তু ‘সারপ্রাইজ দিতে’ এসে কিছুটা বিরক্তিও পেয়ে বসে তাকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। উনি নামবেন দুপুর ২টায়। সারপ্রাইজ দিতে আগেই চলে এসেছিলাম। এখন আনন্দের সঙ্গে বিরক্তিও লাগছে।”
ওয়েটিং লাউঞ্জের কথা বলতেই সুমনা জানালেন, বিষয়টি তার জানা ছিল না।
পাঁচ বছর পর সৌদি আরব থেকে ফেরা রহিবুল হাসানের জন্য বিমানবন্দরের ক্যানোপিতে অপেক্ষা করছিলেন চাঁদপুরের হাইমচর থেকে আসা স্ত্রী শাহীনুর বেগম। ক্যানোপিতে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শ্বশুর-শাশুড়িসহ অপেক্ষা করছি। কিন্তু উনারা বয়স্ক মানুষ; দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বসার জায়গা থাকলে ভালো হত।”
পরে শাহীনুর বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল বিমানবন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জ সম্পর্কে তিনিও অবগত নন।
কেন এই দুই লাউঞ্জ?
ফ্লাইট মিস করার ভয়ে বেশির ভাগ প্রবাসী বেশ আগেই বিমানবন্দরে চলে আসেন। কেউ রাতের ফ্লাইট ধরতে চলে আসেন দুপুরে, কেউ আবার বিকেলের ফ্লাইট ধরতে চলে আসেন সকালে।
যাত্রীদের সঙ্গে তাদের স্বজনরাও আসেন। বিমানবন্দরে মালামাল নিয়ে তারা নানা হয়রানির শিকার হতেন।
এ অবস্থায় যাত্রীদের পাশাপাশি তাদের স্বজনরা যেন শেষ সময়টুকু নির্বিঘ্নে কাটাতে পারেন, মূলত সে উদ্দেশ্যেই গত নভেম্বর বিমানবন্দরে চালু হয় দুটি বিশেষ লাউঞ্জ।
এর মধ্যে ১১ নভেম্বর উদ্বোধন হয় ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’; ১৪ নভেম্বর উদ্বোধন হয় ‘ওয়েটিং লাউঞ্জ’। দুটি লাউঞ্জই উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
পরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য এ ধরনের বিশেষ লাউঞ্জ এটিই প্রথম। দেশে যাতায়াতকালে অভিবাসী কর্মীরা এখানে বিশ্রাম নিতে পারবেন। পাশাপাশি ভর্তুকিমূল্যে নাশতাও পাবেন। আছে ফ্রি ওয়াওইফাই এবং টেলিফোন কলের সুবিধাও।
প্রচার বাড়াতে বসছে সাইনবোর্ড
বিমানবন্দরে লাউঞ্জ দুটি সম্পর্কে অনেকেই না জানার মূল কারণ এটি নিয়ে তেমন কোনো প্রচার হয়নি। আবার ওয়েটিং লাউঞ্জটি যেখানে, সেখানে নেই কোনো ব্যানার বা সাইনবোর্ড।
কার পার্কিং এলাকায় দায়িত্বরত এক এপিবিএন সদস্যের কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চাইলেও তিনি লাউঞ্জের অবস্থান জানাতে পারেননি। অথচ, তিনি যেখানে দায়িত্ব পালন করছেন, তার ঠিক উপরেই লাউঞ্জ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে সাইনবোর্ড বসানোর উদ্যোগ নিতে বিমাবন্দরের নির্বাহী পরিচালককে নির্দেশনা দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা একটা ভালো পরামর্শ। আমি এখনই বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালককে বলেছি, একটা রাইটআপ সেখানে দিয়ে দিতে, যেন এখানে যে একটা লাউঞ্জ আছে, সেটা সহজেই সবার চোখে পড়ে।”
তিনি বলেন, “আমরা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। মন্ত্রণালয় থেকে তিনজন লোক দেওয়া হবে। যারা এই লাউঞ্জে থেকে মানুষকে সার্বক্ষণিক গাইড করবে।”
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই লাউঞ্জ নিয়ে আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। লাউঞ্জের প্রশ্স্ততা, সুযোগ-সুবিধা আর আর নায্যমূল্যে খাবারের বিষয়েও সবাই প্রশংসা করেছেন।”