এবার পূর্বাচলে মাঠ দখল করল কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি
পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে আড়াই বিঘা আয়তনের একটি মাঠ ব্যবহারের আবেদন করে অনুমোদন পাওয়ার আগেই সেটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে দখলে নিয়েছে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউক বলছে, তারা ওই মাঠ ব্যবহারের কোনো অনুমতি দেয়নি, ওই সীমানা দেয়াল ভেঙে ফেলা হবে।
৯ নম্বর সেক্টরের ১০৭ এবং ৪০৪ নম্বর সড়কে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর অবস্থান। চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান।
পূর্বাচল প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রেও ‘নিয়ম ভাঙা হয়েছে বলে’ ২০১৯ সালে আপত্তি তুলেছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
রাজউকে জমা পড়া নথিতে দেখা যায়, মাঠ ইজারা নিতে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লাহ খন্দকারের কাছে আবেদন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আবেদনে বলা হয়, বরাদ্দ পাওয়া সাড়ে আট বিঘা জমিতে ইউনিভার্সিটির কাজ চলমান আছে। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য পাশের জমিটি তাদের প্রয়োজন।
আবেদনটি জমা পড়ার পাঁচ দিন পর ২৪ জানুয়ারি সচিব সেটি পাঠান অতিরিক্ত সচিবের কাছে। ২০ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় চিঠি দেয় রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে।
মন্ত্রণালয়ের উপসচিব লুৎফুন নাহারের স্বাক্ষরে পাঠানো চিঠিতে প্রচলিত বিধি-বিধানের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ’ করার কথা লেখা হয়।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর জন্য বরাদ্দ প্লটের দুইপাশে ১০৭ ও ৪০৪ নম্বর সড়ক। দুটি সড়ক থেকে দুটি প্রবেশ পথ। ১০৭ নম্বর সড়কের পাশের ফটক লাগোয়া একটি দ্বিতল ভবন। একটি সাইনবোর্ডে লেখা ‘ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের প্লটের চারদিকে যে সীমানা প্রাচীর দিয়েছে তার ভেতরে আছে হিসেবে রাখা প্লটটিও।
ওই জায়গায় এখন ফুটবল খেলার মাঠ। দুইপাশে গোল বার। সীমানা প্রাচীর থাকায় সেখানে কোনো লোকজন যেতে পারে না।
প্লটের পাশেই একটি চায়ের দোকানে গল্প করছিলেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। রাজউক প্রকল্পের জন্য তাদের বাড়িঘর অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তবে এখনও বিভিন্ন প্লটে বাড়ি করে তারা থাকছেন।
আইয়ুব হোসেন নামে একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাঠটি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবে তারা মাঠটিকে নিজেদের বাউন্ডারির ভেতরে ফেলে দিয়েছে।”
এ বিষয়ে জানতে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ- এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এইচ এম জহিরুল হক নিজেই ফোন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে জানতে চান, এই বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রতিবেদন হচ্ছে কি না।
কিছুদিন ছুটিতে থাকায় বিষয়টি ‘পুরোপুরি জানেন না’ দাবি করে তিনি বলেন, “রাজউকের মাঠে তো আর আমাদের কোনো অধিকার নাই। আমি যতদূর জানি, ট্রাস্টি বোর্ড সম্ভবত রাজউকের কাছ থেকে মাঠটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনুমোদন নিয়েছিল। নইলে রাজউকের মাঠ আমরা ব্যবহার করব কীভাবে বলেন?”
উপাচার্য আরও বলেন, “আমি যেহেতু দায়িত্বে আছি তাই বলি, মাঠ তো আর আমরা কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে পারব না। রাজউক যদি না দেয় তাহলে আমরা ছেড়ে দেব, বাউন্ডারি তুলে নেব। একটা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হলে কিছু পজিটিভ নিউজ গুরুত্ব বহন করে। একটা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা কারা সেটা ভিন্ন বিষয়। দেখেন নিউজটা কীভাবে পজিটিভলি করা যায়।”
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারি বেশ কিছু প্রকল্পের সুবিধাভোগী বলে সংবাদ মাধ্যমে নাম এসেছে। তার ব্যাংক ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টতা নিয়েও অনেক অভিযোগ আছে।
গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার এবং তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান এবং ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের পরিচালক।
আইন কী বলে
বাংলাদেশে খেলার মাঠ ও জলাধার রক্ষায় ২০০০ সালের মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান এবং প্রাকৃতিক জলাধার আইন কার্যকর আছে। ওই আইনের ৫ ধারায় খেলার মাঠ। উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তনে বাধা-নিষেধ আছে।
এই আইন অনুযায়ী মাঠ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করাও নিষেধ।
যা বলছে রাজউক
রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে কর্মরত একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই মাঠ নিজেদের দখলে নিতে নাফিজ সরাফাত খুবই তৎপর ছিলেন। একবার তাদের দখলে নিতে পারলে সেটি উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে।”
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, “মাঠ ইজারা নেওয়ার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল যখন আমিন উল্লাহ নূরী স্যার আমাদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর শেষ হয়েছে আনিছুর রহমান স্যার যখন চেয়ারম্যান ছিলেন।
পূর্বাচলে 'নিয়ম ভেঙে' কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিকে প্লট
“প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে খাতির থাকায় নাফিজ সরাফাতের ব্যাপক প্রভাব ছিল রাজউকে। তার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকত। সে রাজউকে যতগুলো প্লট পেয়েছে সবগুলোই মন্ত্রণালয়, সরকারের উপর মহল থেকে চাপ দিয়ে রাজউককে অনুমোদন দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা একদিন ওই মাঠটি গিলে ফেলবে।”
রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই মাঠ ব্যবহারের কোনো অনুমতি দেয়নি রাজউক।”
বিস্তারিত জানতে পূর্বাচল শাখার পরিচালক মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
মোহাম্মদ মনির হোসেন হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজউকের মাঠ দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার বিষয়টি তারা জেনেছেন। এ বিষয়ে একটি বৈঠকও করা হয়েছিল। সেখানে মাঠ উচ্ছেদের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
“আমরা মাঠ ব্যবহারের কোনো অনুমতি কাউকে দিইনি। ওই দেয়াল ভেঙে ফেলার জন্য একটা মিটিংয়ে আমাকে ডেকেছিল। আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই দেয়াল ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছি। তারা ওই মাঠ ঘিরে রাখবে কেন, আমরা তো অনুমতি দিইনি। আমরা তো মাঠের লিজ দলিলও করে দিইনি।”
বিষয়টি নিয়ে রাজউকের দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, বিআইপির সভাপতি আদিল মুহম্মদ খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজউকের একটা প্রকল্পে কোথায় কী হচ্ছে তা রাজউকের জানার কথা। একটা বড় মাঠ চারপাশে দেয়াল দিয়ে ঘিরে দখল করে ফেলেছে রাজউক জানে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য না।
গুলশানে আবাসিক প্লটে উঠছে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভবন
“তাদের নিশ্চয়ই কোনো মেকানিজম আছে তারা যে লে-আউট করেছে সেটা ফলো করা হচ্ছে কি না, কেউ কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে কি না। অতীতেও এমন হয়েছে, রাজউক জেনেও না জানার ভান করেছে। শুধু রাজউক না, টপ ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত ম্যানেজ করার মত ক্ষমতা নাফিজ সরাফাতদের মত প্রভাবশালীদের আছে। ওই কালচার এখনও আছে।”
তিনি বলেন, “পূর্বাচল ছাড়াও সরকারের আরও উন্নয়ন প্রকল্পের খোলা জায়গা দখল করে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজউকের উচিত এসব বিষয় দেখা।
“তারা পার্ক, লেক, খেলার মাঠ। দখল করে নিয়েছে। পূর্বাচলে এই মাঠ দখল ছাড়াও আরও অনেক অনিয়ম আছে। ৫ অগাস্টের পর রাজউকের উচিত ছিল এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো। রাজউকের প্রতিটি এলাকায় অথোরাইজড অফিসার আছে, যাদের দায়িত্ব এগুলো দেখভাল করা। তাদের কেন গাফিলতি হল, ওই কর্মকর্তাদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার।”
অভিযোগ ছিল আগেও
রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে ওই প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙা হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলেছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে শ্রেণি পরিবর্তন করে প্লটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বরাদ্দ দেওয়ার কারণও মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছিল।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মূল অনুমোদিত নকশায় এ প্লটকে ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। নাফিজ সরাফাতের আবেদনে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্লটের শ্রেণি ‘সেকেন্ডারি স্কুল’ পরিবর্তন করে ‘কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়’ করার প্রস্তাব রাজউক অনুমোদন করে।
বিষয়টি নজরে আসার পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকের চেয়ারম্যানকে এই প্লট বরাদ্দ নিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়।
সেখানে বলা হয়, “রাজউকের চতুর্থ সংশোধনী পর্যন্ত এবং ৫ম সংশোধনীর প্রস্তাবিত আইকনিক টাওয়ার অংশটুকু মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগের আদেশে বহাল রাখা হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনীর আইকনিক টাওয়ার ছাড়া অবশিষ্ট অংশ এবং পরবর্তী পরিবর্তনসমূহ উল্লিখিত আদেশের প্রেক্ষিতে মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক গৃহীত হয় নাই বিধায় বাতিলযোগ্য।”
নাফিজ সরাফাত তখন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের তখনকার প্রধান উপদেষ্টা সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত পরে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান।
প্লট বরাদ্দে অনিয়মের বিষয়টি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তখন ‘দেখবে’ বললেও পরে আর তা এগোয়নি।