সোমবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, অগ্রাহায়ণ ১৮ ১৪৩১, ৩০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্রেকিং

পৌনে পাঁচ লাখ শূন্যপদে নিয়োগের নির্দেশ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ২ মার্চ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য নেবে ইসি বিপ্লবের মূল কথাই ছিল সংস্কার, সেই সংস্কার করেই নির্বাচন: ড. ইউনূস উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ ‘লুটপাট’ হয়েছে: শ্বেতপত্র কমিটি বিসিএসে আবেদন ফি ‘হচ্ছে’ ৩৫০ টাকা, ভাইভায় নম্বর ১০০ আগরতলায় বাংলাদেশ দূতাবাসে উগ্রপন্থীদের হামলা-ভাঙচুর পাশের দেশের মিডিয়া আমাদের নিয়ে অনেক মিথ্যা প্রচার করছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ আনতে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আলোচনায় রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নতুন মামলায় গ্রেফতার ইনু, মেনন ও দীপু মনি ৪ ডিসেম্বর আমু-কামরুলকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে নির্দেশ আদালতের শ্বেতপত্র: শুধু ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণ দিয়ে করা যেত ২৪টি পদ্মা সেতু ১৫ আগস্ট শোক দিবস পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায় স্থগিত

জাতীয়

২১ আগস্ট মামলায় সবাই খালাস: কেন এ রায়

 প্রকাশিত: ১৮:০২, ১ ডিসেম্বর ২০২৪

২১ আগস্ট মামলায় সবাই খালাস: কেন এ রায়

দুই দশক আগে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার মামলায় হাই কোর্টের রায়ে আসামিদের সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে অভিযোগ গঠনে ত্রুটির কারণ দেখিয়ে।

আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এ রায় দেয়।

জজ আদালত এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিল।

সেই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল মঞ্জুর করার পাশাপাশি মৃত্যদণ্ড কার্যকরের আবেদন (ডেথ রেফারেন্স) হাই কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে।

জজ আদালতে দণ্ডিত ৪৯ আসামির মধ্যে যারা আপিল করেছেন, তাদের পাশাপাশি যারা করেননি, সবাইকে এ মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে হাই কোর্টের রায়ে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে যে সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল, সেই অভিযোগপত্রই ছিল ‘অবৈধ’।

এ ছাড়া কোনো সাক্ষী কোনো আসামিকে গ্রেনেড ছুড়তে দেখেননি, তাই শুধু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া যায় না বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে কোর্ট।

রায়ের পর আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “মুফতি হান্নানের দুইবার কনফেশন নেওয়া হয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে বিচারিক আদালত রায় দেয়। উপমহাদেশের চারশ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় কনফেশনের ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি। এবার আমরা এর সাক্ষী হলাম।”

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, “এ মামলায় দুইবার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এক আসামির দ্বিতীয়বার কনফেশন (ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি) নিয়ে পরে আরেকটি চার্জশিট দেওয়া হয়, যেটা আইনে গ্রহণযোগ্য নয়।

“আদালতে আমরা এটা বলেছি, আদালত সেটা গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া সাক্ষীরা কোনো আসামিকে গ্রেনেড ছুড়তে দেখেননি। তাই সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এ রকম একটি মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা সবাই ব্যথিত। কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো যে কাউকে আসামি করে সাজা দেওয়া যায় না। এ রায়ে তাই প্রমাণ হয়েছে।”

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ওই ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন তুলেছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেতা।

১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা দুই মামলার রায় দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

সেই রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আর খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এছাড়া এ মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।

তিনি বলেন, “রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।”

২১ অগাস্ট হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেছিলেন।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ওই হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। তারা সহযোগিতা নেয় বিদেশি জঙ্গিদের। আর এই ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে।

পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হলে নতু তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। জানা যায়, হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেওয়ার বিষয়টি ছিল নাটক।

ঘটনার চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।

জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে।

সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে।

২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। নতুন করে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর জজ আদালতের রায়ে ৪৯ আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

২০০৮ সালের ১ নভেম্বর ১৬৪ ধারায় মুফতি হান্নানের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গ্রেনেড হামলায় তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি সে ঘটনার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের নানাদিক উঠে আসে বলে সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছিলেন।

তারা বলেছিলেন, জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে শত্রু ভাবে, সেটাকে কাজে লগিয়ে ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনাশ’ করতে চাইছিলেন তারেক।

তবে ওই জঙ্গি নেতার জবানবন্দিকে বানোয়াট দাবি করে বিএনপি ও তারেকের আইনজীবীরা বলছিলেন, মুফতি হান্নানের কাছ থেকে ‘জোর করে’ ওই বক্তব্য আদায় করা হয়েছিল।

২১ অগাস্ট মামলার রায়ের আগেই অন্য মামলায় মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। তবে মৃত্যুর আগে তিনি ২১ অগাস্ট মামলায় তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলেন বলে তারেকের আইনজীবীরা সে সময় বলেছিলেন।

রোববার হাই কোর্টের রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন জানান, “এখানে মূল বিষয়টি আরম্ভ হয়েছে জনসভার পারমিশন নিয়ে। জনসভার পারমিশন সরকার দিয়েছিলেন পাশের একটি মাঠে। সরকারকে পরবর্তী পর্যায়ে না জানিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ওই স্থান পরিবর্তন করে এ রাস্তার মধ্যে নিয়ে আসেন।

“এটা ছিল তার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যে সরকারি দলকে একটা বেকায়দায় ফেলাবার জন্য তিনি এ কাজটি করেছিলেন। সেজন্য এ যে গ্রেনেড হামলাটা হয়েছিল, আমাদের বিশ্বাস-রাজৈনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ গ্রেনেড হামলটা তখন হয়েছিল।”

তিনি বলেন, “প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম কোথাও ছিল না। সাবসিকোয়েন্টলি আব্দুল কাহার আকন্দকে দিয়ে এ মামলার মধ্যে তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করেন। তাকে সম্পৃক্ত করে এ মামলায় সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।”

জয়নুল আবেদীন বলেন, “আদালত সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করেছে, দেখেছে যে সাক্ষ্যে, যে চার্জশিটে তাদেরকে সাজা দেওয়া হয়েছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে- এ মৃত্যুদণ্ড টিকতে পারে না। ডাইরেক্ট কোনো এভিডেন্স না থাকলে কাউকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া যায় না, সেখানে আজীবন সাজাও দেওয়া যায় না “

এ আইনজীবির ভাষ্য, “সমস্ত দিক বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছে এ মামলায় যারা আপিল করেছে এবং যারা আপিল করতে পারেনি প্রত্যেকেকেই খালাস দেওয়া প্রয়োজন।

“এ মামলাটিকে সারাবছর আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। তারা চেয়েছিল তারেক রহমানকে মামলা দিয়ে চিরজীবন তাকে বাইরে রাখবেন এবং এমনকি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদালত এরকম কোনো এভিডেন্স পায়নি যে তারেক রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আজকে এ জাজমেন্টের মাধ্যমে সবাই খালাস পেলেন।”