সাত দিনের মধ্যে সুরাহা চান ব্যাটারি রিকশার চালক-মালিকরা
ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশ পুনর্বিবেচনাসহ লাইসেন্স ও রুট পারমিট দিতে নীতিমালার বিষয়ে সুরাহা করতে সাত দিন সময় বেঁধে দিয়েছে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ।
অন্যথায় আগামী ৩০ নভেম্বর ঢাকার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে দেশের ৬৪ জেলায় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সংগঠনটির ঢাকা মহানগর শাখা আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে আল্টিমেটাম দিয়ে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন সংগঠনের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন।
তিনি বলেন, “ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মহাসড়কে চলাচল না করতে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় এখনও বহাল রয়েছে। তারপর হাই কোর্ট কীভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে রায় দেয়? সুপ্রিম কোর্টের যে রায় আছে তার ফলে হাই কোর্টের রায় এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়।”
২০২২ সালের এপ্রিল ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহন মহাসড়কে উঠতে পারবে না বলে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এর ফলে মহাসড়ক ছাড়া অন্য সব সড়কে এই যানগুলো চলার বৈধতা পায়।
গত মঙ্গলবার উচ্চ আদালত থেকে ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ আসে।
প্যাডেল চালিত রিকশা সমিতি করা একটি রিটের প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
এর পরদিনই ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল অব্যাহত রাখার দাবিতে দয়াগঞ্জ মোড়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন রিকশাচালকরা।
বৃহস্পতিবার ঢাকার মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধসহ মিরপুর, মালীবাগ, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, আগারগাঁও, নাখালপাড়া, রামপুরা, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা।
সর্বশেষ শুক্রবার ঢাকার জুরাইনে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রিকশাচালকদের বিক্ষোভ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উচ্চ আদালতের রায়টি পুনর্বিবেচনাসহ সমস্যা সমাধানে সাত দিনের আল্টিমেটাম দিল রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ।
একটা নীতিমালা তৈরি করে আধুনিকায়ন করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের লাইসেন্স দেওয়া, রুট পারমিট ও সড়কে পৃথক লেনের দাবিতে সংগঠনটি ১২ বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান সংগঠনটির আহ্বায়ক।
তিনি বলেন, “গত ৬ জুলাই বিআরটিএ থেকে আমাদের চিঠি দিয়ে জানানো হলো আমাদের দাবিটা যৌক্তিকভাবে পরিচালনা করছে। গত ২৪ অক্টোবর আমাদের জানানো হল নীতিমালা চূড়ান্ত হয়ে আছে।
“আমরা যখন অশায় বুক বেঁধে আছি। কিন্তু প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের একটি সংগঠন রিট করল। পেটে লাথি মেরে কোনো রিট হতে পারেনা।”
সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আপনি একটা নীতিমালা করে লাইসেন্স দিয়ে, নিবন্ধন করে রুট পারমিট দিয়ে দিন। যখন লাইসেন্স আর রুট পারমিটের বিষয়টি আসবে তখনই নিরাপত্তার বিষয়টি চলে আসবে। তাই নীতিমালাটা অবিলম্বে ৭ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত করুন।
“আমরা মহাসড়কে উঠতে চাই না। বাইলেন সার্ভিস করে দিন। আমরা ধৈর্য ধরে আন্দোলন করছি, এখনও সারাদেশে করি নাই। সারাদেশে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশার সাথে ৩ কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। তাই আপনারা হুঁশিয়ার হয়ে যান। অবিলম্বে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবদান মনে করিয়ে তিনি বলেন, “৩৬ দিনের আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা আহত-নিহতদের আনা-নেওয়া করেছেন। এর দায়ে উত্তরাতে আমাদের এক ভাইকে গুলি করে পা ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছিল। অভ্যুত্থানে যে ১৪৮১ জন মানুষ মারা গেছে তার মধ্যে দুই-আড়াইশ ছাত্র। বাকিরা শ্রমজীবী, তার মধ্যে রিকশাশ্রমিকরাও আছে।”
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে 'পরিবেশ বান্ধব' আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “৬০ লাখ রিকশাকে লইসেন্স দিয়ে নিবন্ধন দিলে একমাসে নগদ ১০ হাজার কোটি টাকা ঢুকবে। তাহলে আমাকে রাজস্বে ঢুকাবেন নাকি বাদ দিয়ে দিবেন?”
শুক্রবার রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গ্যারেজ আটকে চালকদের ওপর হামলা হয়েছে অভিযোগ এনে 'কারা হামলা করেছে' এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব বুলবুল বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে একমাত্র পথ থাকে রিভিউ করা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিপরীতে হাই কোর্টের রায় দেওয়ার এখতিয়ার নেই। সেটা বাতিল বলে গণ্য হয়। হাই কোর্টে যারা তথাকথিত রিটটি করলেন, পেছনে অস্থিশীলতা তৈরির চক্রান্ত থাকলেও থাকতে পারে।
“হাই কোর্টের এই নির্দেশের পরে শ্রমিক যখন প্রতিবাদ করছে, আলোচনা করে তাদেরকে রাস্তা থেকে সরানোর কার্যক্রমে না যেয়ে শক্তি প্রয়োগ করছেন। মুখে ফ্যাসিবাদের কথা বলে আপনারাও একই পথে হাঁটছেন।”
নীতিমালা এবং নিবন্ধন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে চলাচলের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই সংগঠন ঘরে ফিরবে না। শৃঙ্খলা দেখাব মানেই নিপীড়ন আসলে মুখ বুজে মেনে নিব না। যে হাত নিপীড়ন করবে সেই হাত ভেঙে দিতে পারি।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ সরকারের উদ্দেশে বলেন, “আপনার যদি খাবারের সন্ধান, কাজ দিতে না পারেন, কোনভাবেই তারা নিজেরা যে ব্যবস্থা করেছে সেটাকে উচ্ছেদ করার অধিকার নাই।”
রিকশা শ্রমিকনেতা আফজাল হোসেন বলেন, “আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন, আমরা আর রিকশা চালাব না। কর্মসংস্থান না করে রিকশা বন্ধ করা চলবে না।”
গত মে মাসে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত কোনো রিকশা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বিদ্যুৎচালিত তিন চাকার যানগুলো অটো, ইজিবাইকসহ নানা নামে পরিচিত। দুর্ঘটনার জন্য সড়কে মোটরবাইক এবং ইজিবাইকের চলাচলকে দায়ী করেন তিনি।
সে সময় ঢাকার সাবেক দুই মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং আতিকুল ইসলামও শহরের মধ্যে এসব ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধের বিষয়ে তাদের সম্মতি জানিয়েছিলেন।
পরে ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় সড়ক অবরোধ করেন চালকরা ও গ্যারেজ মালিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংক্ষুব্ধ চালকদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
পরে ‘জীবিকার’ বিষয়টি বিবেচনায় এনে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করবে পারবে বলে ঘোষণা দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।