বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, কার্তিক ২৯ ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

গাজীপুরে শ্রমিকদের টানা অবরোধ, মহাসড়কে ২০ কিলোমিটার যানজট

 প্রকাশিত: ১২:০১, ১০ নভেম্বর ২০২৪

গাজীপুরে শ্রমিকদের টানা অবরোধ, মহাসড়কে ২০ কিলোমিটার যানজট

বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে গাজীপুরে টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছেন পোশাক শ্রমিকরা।

এতে মহাসড়কের উভয় পাশে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজট তৈরি হয়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন পরিবহন শ্রমিক, যাত্রীসহ সাধারণ মানুষ।

রোববার সকাল ৯টায় গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হওয়া শ্রমিকদের আন্দোলন রাতভরও চলছিল। তারা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করে রেখেছেন।

“এ কারণে মহাসড়কের উভয় পাশে টঙ্গী থেকে রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।”

গাজীপুর মহানগরের মালেকের বাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা এই শ্রমিকরা টিএনজেড অ্যাপারেলস্ লিমিটেড নামের কারখানার কর্মী।

শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এপ্রিল মাস থেকে কারখানা বন্ধ ছিল। সেপ্টেম্বরে কারখানা খুললেও দুই মাসের বেতন না দিয়ে কর্তৃপক্ষ তালবাহানা করছে। বেতনের দাবিতে তারা কয়েকবার সড়কে নেমেছেন।


কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বারবার বেতন পরিশোধের তারিখ দিলেও এখন পর্যন্ত তা দেয়নি। যার কারণে বাধ্য হয়েই তাদের আবার রাস্তায় নামতে হয়েছে। রাতভর নির্ঘুম কাটিয়েছেন মহাসড়কেই।

শনিবার গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খলিলুর রহমান বলেছিলেন, টিএনজেড গ্রুপের ছয়টি কারখানার সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের বেতন বকেয়া আছে। শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের বেতন পরিশোধের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ তা পরিশোধ করেননি।

শ্রমিকরা বলছেন, মহাসড়কে হাজার হাজার মানুষের চরম ভোগান্তির কথা জানলেও বকেয়া বেতন পরিশোধ না করা পর্যন্ত সড়কেই অবস্থানের সিদ্ধান্তে তারা অটল। পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো আশ্বাস ও কথাই শুনতে নারাজ তারা।

সড়কে নির্ঘুম রাত কাটানো শ্রমিক আসমা আক্তার বলেন, “আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। পুলিশ ও প্রশাসন বারবার আমাদের বকেয়া বেতন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে আমাদের দাবি মেটানো হয়নি।

“বাসা ভাড়া, দোকানের বাকি পরিশোধ করতে পারছি না। ঘরে খাবার নেই, সন্তানকে বাবার কাছে রেখে আমি বেতনের দাবিতে সারারাত রাস্তায় কাটিয়েছি।”

অপর শ্রমিক শাহানা আক্তার বলেন, “আমরা মানুষের দদুর্ভোগ ও কষ্টের কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের কষ্টের কথাও সবাইকে বুঝতে হবে।

“আমরা শখ করে রাস্তায় রাত জেগে বসে থাকিনি। আমরা আমাদের বকেয়া বেতন পেলেই অবরোধ তুলে নেবো। ”

সড়কে আটকা পড়ে চরম দুর্ভোগ

এদিকে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হওয়া সড়ক অবরোধের কারণে অনেক যানবাহন ১৫-২০ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় আটকা পড়ে আছে।

রাজশাহী থেকে ট্রাকযোগে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাক চালক ইকবাল হোসেন বলেন, “শনিবার সকাল ১০টার দিকে ভোগড়া বাইপাস মোড়ে আসি। এর পর রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত মাত্র আধা কিলোমিটারের মতো পথ আসতে পেরেছি। রাস্তা সরু হওয়ায় গাড়ি ঘুরিয়ে বিকল্প পথে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।”

প্রাইভেটকার চালক সাফায়েত হোসেন বলেন, “জরুরি কাজে অফিসের স্যারকে নিয়ে শনিবার দুপুর থেকে বাসন সড়ক এলাকায় আটকা পড়েছি। বস অন্য গাড়িতে চলে গেলেও আমি রাস্তায় পড়ে আছি।

“খাবার, গোসল সবকিছু বন্ধ। গাড়ি রাস্তায় রেখে কোথাও যেতেও পারছি না। সারারাত গাড়ির মধ্যে আতঙ্কে নির্ঘুম কাটিয়েছি।”

রাজশাহী থেকে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আসা যাত্রী শফিক আহমেদ বলেন, “সকালে ভোগড়া বাইপাস মোড়ে বাস থেকে নেমে ঢাকায় যাওয়ার কোনো যানবাহন না পেয়ে দুই সন্তান স্ত্রী ও দুটি ব্যাগ নিয়ে অনেক কষ্ট করে এক কিলোমিটারের মতো পথ হেঁটে এসেছি।

“এখন আর পারছি না। জানতে পারলাম আরও এক কিলোমিটার পথ হেঁটে পার হলে কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে। ”

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আটকে পড়া পণ্যবাহী যানবাহনের মধ্যে পচনশীল পণ্যও রয়েছে। যাত্রীবাহী অনেক বাস থেকে যাত্রীরা নেমে পায়ে হেঁটে বা বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন ফলে অনেক যানবাহন যাত্রী শূণ্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তাকওয়া পরিবহনের হেলপার আসিফ জানান, “রোববার সকালে জৈনা বাজার থেকে যাত্রী তুলে জয়দেবপুর চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বাসটি কয়েক ধাপে ছোট ছোট যানজট পেরিয়ে রাজেন্দ্রপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান পর্যন্ত যেতেই যানজটে আটকে যায়।”

এদিকে শ্রমিক আন্দোলনে যানজটের কারণে মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন কম চলাচল করছে। স্বল্প দূরত্বের লোকাল পরিবহন চলাচল করলেও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ তুলছেন যাত্রীরা।

রোববার সকালে রাজধানীর উদ্দেশ্যে যেতে শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় দূরপাল্লার বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব আব্দুল কাদির।

তিনি বলেন, “ঢাকায় যেতে অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি। জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১৫০ টাকা ভাড়া চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু অন্য বাসগুলো জানাচ্ছে, রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাকী রাস্তায় যানজট। এখন বেশ চিন্তায় আছি।”

মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ, উত্তর) নাজির আহমেদ বলেন, “শনিবার সকাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ বার শ্রমিকদের সাথে আমরা দফায় দফায় আলোচনা করেছি। মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে দ্রুত তাদের বকেয়া আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

“কিন্তু অতীতে মালিকপক্ষ কথা রাখেনি এমন অভিযোগ তুলে শ্রমিকরা প্রথমে বলেছিল দুপুর ২টায় অবরোধ তুলে নিবে। পরে বলেছিল বিকাল ৫টায় অবরোধ তুলে নিবে, কিন্তু তারা অবরোধ তুলে নেয়নি।

“তারপরও আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তারা কোনো আশ্বাস মানতে রাজি হচ্ছে না। ফলে মহাসড়কের যানজট নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না।”

গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ইব্রাহিম খান বলেন, শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধের দক্ষিণ দিকে টঙ্গীর কাছাকাছি যানজট গিয়ে পৌঁছায়। অনেক গাড়ি বিকল্প পথে চলাচল করছে। এছাড়াও মহাসড়কে অনেকগুলো ডাইভারসন আছে সেগুলো দিয়ে চালক ও যাত্রীরা চলাচল করছে।

“আমরা মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।”

এছাড়াও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে বিকল্প সড়ক ব্যবহারে অনুরোধে করে একটি ট্রাফিক আপডেট দেয়া হয়েছে।

ওই আপডেটে বলা হয়েছে, “সম্মানিত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ব্যবহারকারী যাত্রীবৃন্দের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকগণ কর্তৃক ভোগড়া বাইপাস ও মালেকের বাড়ীর মাঝামাঝি কলম্বিয়া গার্মেন্টসের সামনে শনিবার সকালে শুরু করা মহাসড়ক অবরোধ এখন পর্যন্ত (সকাল ৯টা) অব্যাহত আছে। যাত্রীগণকে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।”