নৈতিক স্খলনের অভিযোগে জবি শিক্ষক বরখাস্ত
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু সালেহ সেকেন্দারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ মো. গিয়াস উদ্দিনের স্বাক্ষরিত এ আদেশে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভাগীয় অ্যাকাডেমিক কমিটির আনীত অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ১২ ধারার আলোকে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫- এর ধারা ১১(১০) মোতাবেক সিন্ডিকেটের রিপোর্ট সাপেক্ষে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু সালেহ সেকেন্দারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো।”
বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ওই ধারায় বলা আছে, “বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে জরুরী পরিস্থিতির উদ্ভব হইলে এবং ভাইস-চ্যান্সেলরের বিবেচনায় তত্সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজনীয় বিবেচিত হইলে তিনি সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবেন এবং যে কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা সাধারণতঃ বিষয়টি সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার অধিকারপ্রাপ্ত সেই কর্তৃপক্ষ বা সংস্থাকে, যথাশীঘ্র সম্ভব, ততকর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা অবহিত করিবেন৷”
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অধ্যাপক শেখ গিয়াস উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার পতনের আগে বিভাগের বিভিন্ন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আসে। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি (আবু সালেহ) শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্ট্যাটাস দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন এবং বিভাগের প্রত্যেকটি রুমে তালা দিয়ে রাখেন।
“ফলে শিক্ষকরা ক্লাস নিতে পারছিলেন না। বুধবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে- শিক্ষার্থীরা তার উপর বিভিন্নভাবে আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। দায়িত্বশীল শিক্ষকরা সেটা মোকাবিলা করে ওই শিক্ষককে উপাচার্যের কাছে নিয়ে আসেন।"
তিনি বলেন, “পরে সিন্ডিকেটে- রিপোর্ট সাপেক্ষে ও পরিস্থিতি শান্ত করতে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। রিপোর্ট সাপেক্ষে দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হবে। তদন্ত রিপোর্ট সাপেক্ষে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
সম্প্রতি আবু সালেহ সেকেন্দার অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনে একটি কলাম লেখেন, যার শিরোনাম ছিল- ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ভুল সিদ্ধান্ত'। এই লেখার মাধ্যমে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ তোলেন। পরে লেখাটি সরিয়ে নেওয়া হয়।
ওই অভিযোগ তুলে মঙ্গলবার আবু সালেহ সেকেন্দারকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন একদল শিক্ষার্থী। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিও জানান।
পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ওই শিক্ষক ক্যাম্পাসের শান্ত চত্বরে আসা মাত্রই শিক্ষার্থীরা তাকে ঘিরে ধরে জড়ো হন। তারা ‘ভুয়া, ভুয়া’ দুয়োধ্বনি তুলে ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করে পুলিশে দেওয়ার দাবি জানান।
ঘটনাস্থলে তখন প্রক্টর অধ্যাপক তাজাম্মুল হক এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। সেদিন বিকালেই আবু সালেহকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তাজাম্মুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীরা উনার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের রিপোর্ট সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”
অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি প্রসঙ্গ
২০১৯ সালে আবু সালেহ সেকান্দারের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ অভিযোগ দেন বিভাগের ৪ ছাত্রী। পরে আরও ২২ শিক্ষার্থী লিখিত আবেদনে বলেন, তারা ওই শিক্ষকের ক্লাস করতে চান না। এসব অভিযোগে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে তাকে অব্যাহতি দেয় অ্যাকাডেমিক কমিটি।
বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সালে বিভাগের এক ছাত্রীকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে গিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় আটক হন আবু সালেহ। ওই ঘটনায় তিনি ওই ছাত্রীকে বিয়ে করতে বাধ্য হন।
বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতিয়ার রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আবু সালেহ সেকেন্দারের বিরুদ্ধে তো অভিযোগ বলে শেষ করা যাবে না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অনেক পুরনো। তখন উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক মীজানুর রহমান।
“নারী শিক্ষার্থীদের সাথে অশালীন আচরণের অভিযোগ, বিভাগের সহকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রাখাসহ ফেইসবুকে বিভিন্ন সময়ে অশালীন ভাষায় বিভাগ ও বিভাগের শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করে তিনি পোস্ট করেন। তার বিরুদ্ধে একই ব্যাচের একাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরা খেলে বাধ্য হয়ে একজন ছাত্রীকে বিয়ে করতে হয়েছে।”
অধ্যাপক আতিয়ার বলেন, “আমরা বিভাগের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে বসে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা বিভাগের পক্ষ থেকে এসব সুস্পষ্ট অভিযোগসহ উপাচার্য বরাবর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগপত্র দিয়েছিলাম।
“কিন্তু পূর্বের প্রশাসন কেন জানি না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে গড়িমসি করেছিল। তাদের আচরণে তদন্তের গতিশীলতা ছিল না, বরং ধামাচাপা দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলাম। অবশেষে গতকাল প্রাথমিক একটি সিদ্ধান্ত আসল।”
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে আবু সালেহ সেকেন্দারকে একাধিবার কল ও এসএমএস করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।