বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, মাঘ ২ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

‘সবার সরকার’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউনূস সরকারের যাত্রা

 আপডেট: ১৭:৩১, ৯ আগস্ট ২০২৪

‘সবার সরকার’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউনূস সরকারের যাত্রা

গণ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগকে মাথার রেখে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে ‘নতুন বাংলাদেশে’ উত্তরণের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করল নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; যেখানে সবাই পাবে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা।

বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে শপথ নিয়ে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করলেন সবাইকে; বললেন, ”ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার হবে দেশের সবার সরকার।”

নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের, সুবিচারের, মানবাধিকারের ও নির্ভয়ে মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি।

অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে ‘রাষ্ট্র পুর্নগঠনের’ কাজকেও অগ্রাধিকার দেবে বলে তুলে ধরেন আন্দোলনের মাঠের ছাত্র প্রতিনিধি থেকে উপদেষ্টা হওয়া নাহিদ ইসলাম।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের সংস্কার কাজটি করতে হবে। পুরো বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাতে হবে।”

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ জনের উপদেষ্টা পরিষদ এমন এক সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নিল যখন দেশে চার দিন ধরে কোনো ধরনের সরকার নেই। চারিদিকে বিরাজ করছে অরাজক পরিস্থিতি, পুলিশবিহীন দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করছে শিক্ষার্থী-স্বেচ্ছাসেবকরা।

ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদ: কার কী পরিচয়

ছাত্র-জনতার তুমুল গণ আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটার আগে ও পরে সহিংসতা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলন ঘিরে প্রাণ গেছে কয়েকশ মানুষের; আহত হয়ে এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অনেকে।

এমন সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস তার নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, যার ঠিক চার দিন আগে বিদায় হয়েছে টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা থাকা শেখ হাসিনার সরকার; গণআন্দোলনের মুখে দেশে ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি।

প্রাণভয়ে পুলিশ বাহিনীর পলায়নপর অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে অরাজক পরিস্থিতি। থানায় থানায় নেই পুলিশ, প্রশাসন-আদালতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অস্থিতিশীলতা।

সেনাবাহিনী ও পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে এসেছে বড় পরিবর্তন; নতুন আইজিপি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজে ফিরতে নির্দেশনা দিলেও তা হয়নি।

দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হচ্ছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আর বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকরা। এসব হামলা-পাল্টা হামলায় সারাদেশে শতাধিক মানুষের প্রাণক্ষয় হয়েছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেও শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে অনেক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে বঙ্গভবন এলাকায়; যে পালাবদল হল, তার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বাস্তবিক পরিবর্তন চাইছেন তারা সবাই।

তাদের মত একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাখাওয়াত আল আমিন।

অন্তর্বর্তী এই সরকারের শপথের পর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদ তথা 'নতুন স্বাধীন' দেশের সরকার কারা চালাবেন তা ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন। এখন এই সরকারকে যদি সেই 'স্বপ্নের বাংলাদেশ' বিনির্মাণ করতে হয় তাহলে এমন কিছু করতে হবে যার নজির পৃথিবীতেই নেই।

“একটু এদিক-সেদিক হলেই আবার যা তাই, রাষ্ট্র আবার আগের প্যাভিলিয়নে ফিরে যাবে। কারণ, 'প্রতিটা নিষ্ঠুর শাসন বিপ্লব ডেকে আনে, বিপ্লব আবার নিষ্ঠুর শাসন অনিবার্য করে তোলে।' তবে আশা করি আমাদের প্রফেসর সাহেব 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা' হয়ে সেই অসাধ্য সাধন করে দেশকে সঠিক এবং কার্যকর গণতন্ত্রের দিকে ফিরিয়ে আনবেন।”

তরুণ লেখক অনুপম দেবাশীষ রায় বলেন, “এখন ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন, শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য, সংবিধান সংস্কারের জন্য। যাতে করে শেখ হাসিনা যেই কাঠামো দিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল সেই অবস্থার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। নতুন করে কেউ যেন স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে।

“ভবিষ্যতে যেই দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হতে না পারে। নতুন করে আয়না ঘরের মতো বিভীষিকাময় টর্চার সেল যেন গড়ে না ওঠে। সেজন্য দুই বারের বেশি কোনো ব্যক্তি যেন প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান যেন একই ব্যক্তি না হয়, এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য আসে।”

পাশাপাশি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করা, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচন থেকে আলাদা করার সংস্কারের পরামর্শ তার।

শপথ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে আহতদের খোঁজখবর নেন তিনি।

নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

নতুন সরকারের শপথগ্রহণের পর এক্স এ এক বার্তায় তিনি বলেছেন, “নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করায় মুহাম্মদ ইউনূসকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আমরা আশা করছি, দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে এবং হিন্দুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়া হবে। অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও সে সুবিধা পাবে।”

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করতে প্রস্তুত থাকার কথা এর আগেই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শপথ গ্রহণের পর তাকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র দপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, “আমরা জেনেছি, নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে সম্মত হয়েছেন।

“যেহেতু এই সরকার বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের লক্ষ্য ঠিক করেছে, আমরা এই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি।”

শপথ অনুষ্ঠান

বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের নতুন এক অধ্যায় রচিত হওয়ার পর ‘তরুণদের দেখানো পথে’ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। এই যাত্রায় উপদেষ্টা হিসেবে তার সঙ্গে থাকছেন আরও ১৬ জন।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।

নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং পরে গোপনীয়তার শপথ নেন ইউনূস। শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাকে অভিনন্দন জানান।

এরপর ১৬ উপদেষ্টার নাম ঘোষণা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ১৩ জন একসঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেন। শপথ নেওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী শপথ বইতে সই করেন সবাই।

যারা উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দুই তরুণ তুর্কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নাহিদ ইসলাম ও সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

তাদের মধ্যে নাহিদের বয়স ২৬, আর আসিফের ২৫। বাংলাদেশে এত কম বয়সে সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার নজির আর কারও নেই।

১৬ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের চারজন নারী। তারা হলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের তিন উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, এম সাখাওয়াত হোসেন ও আ ফ ম খালিদ হাসান
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের তিন উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, এম সাখাওয়াত হোসেন ও আ ফ ম খালিদ হাসান

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন শপথ নিয়েছেন উপদেষ্টা হিসেবে।

লেখক, রাজনীতি-বিশ্লেষক ও কলামিস্ট অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খানও পেয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব।

শপথ নিয়েছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর ও সুন্নী দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত আ ফ ম খালিদ হাসান।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, অপারেশন জ্যাকপটে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক, সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় ঢাকার বাইরে থাকায় শপথ নিতে বঙ্গভবনে আসতে পারেননি।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে গুলশান থেকে বঙ্গভবনে পৌঁছান মুহাম্মদ ইউনূস। সোয়া ৯টার দিকে তাকে নিয়ে বঙ্গভবনের দরবার হলে আসেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন।

বঙ্গভবনের দরবার হলে এ শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। এরপর কোটা সংস্কার ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘শহীদদের’ স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন সবাই।

ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর শুরু হয় শপথগ্রহণ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। সবশেষে ছিল চা পানের পর্ব।

ছিলেন প্রায় সবাই, আওয়ামী লীগ ছাড়া

রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, কূটনীতিকসহ সরকারি ও সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন প্রায় চারশ অতিথির মধ্যে। যেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি কেউ উপস্থিত ছিলেন না।

দরবার হলে প্রথম সারির মাঝখানে বসেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তার বাম দিকে বসেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, এরপর বসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এরপর অন্তবর্তীকালীন সরকারের অন্য উপদেষ্টারা বসেন।

প্রধান উপদেষ্টার ডান দিকে রয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান।

এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ।

হুইল চেয়ারে দ্বিতীয় সারিতে বসেন ড. কামাল হোসেন। এরপর তৃতীয় সারিতে বসেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। শপথ অনুষ্ঠানে ছিলেন না স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকেও দেখা যায়নি। তার আসনটি শূন্য ছিল।

অপরদিকে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বঙ্গভবনে আসলেও বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘ভুয়া, ভুয়া’ ধ্বনি আর তোপের মুখে প্রবেশ করতে পারেননি তিনি।

১/১১ এর পট পরিবর্তনের পর থেকে দীর্ঘ সময় পর বঙ্গভবনের কোনো শপথ অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের দেখা গেল। সবশেষ ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ অনুষ্ঠান বিএনপি বর্জন করে।

প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস শপথ করেন, “আমি আইন অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব। আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।”

গোপনীয়তার শপথে তিনি বলেন, “আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রূপে যেসব বিষয় আমার বিবেচনার জন্য আমার বিবেচনার জন্য আনিত হবে বা যেসব বিষয় আমি অবগত হইব তা প্রধান উপদেষ্টা রূপে যথাযথভাবে আমার কর্তব্য পালনের প্রয়োজন ব্যতীত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তিকে জ্ঞাপন করব না বা প্রকাশ করব না।”

ইউনূসকে নিয়ে 'অত্যন্ত আশাবাদী' ফখরুল

ভিন্ন ও নতুন এক প্রেক্ষাপটে সরকারবিহীন সময়ে বাংলাদেশে পঞ্চমবারের মত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হল মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে।

গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে।

এরপর ১৯৯৬ সালে সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত হয়। তখন বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সপ্তম জাতীয় নির্বাচনের সময় দায়িত্ব সামলায়। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন এবারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নবম জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হলেও তারা নির্বাচন আয়োজন করতে পারেননি।

আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদের আন্দোলনের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে দেন ইয়াজউদ্দিন। এরপর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়।

নির্বাচন অনুষ্ঠানে তিন মাসের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান থাকলেও সেনানিয়ন্ত্রিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভোট আয়োজনে সময় নেয় প্রায় দুবছর।

বাকি তিনজনের শপথ কবে

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক বলেন, দেড়মাস ধরে মেয়েদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। প্রধান উপদেষ্টা চাইলে ১৪ অগাস্টে দেশ ফেরার পর শপথ নেবেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৪টায় বাংলাদেশ থেকে ফোন পেয়েছেন উপদেষ্টা হিসেবে তার নাম প্রস্তাব হিসেবে। আগামী ১২ অগাস্ট দেশে ফেরার টিকিট করা আছে। ১৪ অগাস্ট ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়া সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের জন্য টেলিফোন পেয়েছেন। রাঙামাটিতে অবস্থান করায় এত অল্প সময়ে ঢাকায় আসা সম্ভব হয়নি। পরে শপথ নেবেন তিনি।

ময়মনসিংহ থেকে ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রব মোশাররফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি শুরুতে দায়িত্বটা নিতে ‘অনাগ্রহী’ ছিলেন, পরে ৯টার দিকে রাজি হয়েছেন।

“মন্ত্রিপরিষদ সচিব এরপর উনার সঙ্গে কথা বলেছেন। পরে যেদিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ঠিক করবে, সেদিন তিনি শপথ নেবেন।”

শপথ নিয়ে কী বললেন তারা

শপথ গ্রহণ শেষে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান ‍উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার দেশের সবার সরকার। এখানে সবার আকাঙ্খা পূরণের অধিকার থাকবে।

সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকি, সবার জন্য মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি আমাদের বিজয় অবশ্যই হবে।”

ছাত্র-জনতার এ অর্জনকে অনেক দূর নিয়ে যেতে সরকারের লক্ষ্য তুলে ধরে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের, সুবিচারের, মানবাধিকারের ও নির্ভয়ে মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।

”সকলের স্বাচ্ছন্দে জীবনধারণের সুযোগ প্রদানে সচেষ্ট সরকারের দলমত নির্বিশেষে সকলেই উপভোগ করবে। এটাই আমাদের লক্ষ্য।”

নতুন প্রধান উপদেষ্টা বলেন,”আমাদেরকে এই লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করুণ। সারা বিশ্ব আজ বলছে সাবাশ বাংলাদেশ, সাবাশ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা। আমরা এই অর্জনটাকে আরও অনেক দূর নিয়ে যেতে চাই। আমাদের ছাত্র-জনতার জন্য কিছুই অসম্ভব নয়।”

তরুণদের পক্ষে সব অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা সেজন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকি। সবার জন্য মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারি, আমাদের বিজয় অবশ্যই হবে।”

সব ধরনের অপরাধের বিচার করার কথা তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “বিভিন্ন চেষ্টায় ব্যবহৃত হয়ে যারা অপরাধ সংগঠিত করেছেন, তাদেরকে আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে শীঘ্রই উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। একই কথা দেশের সকল মন্ত্রণালয়, সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নানা কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য। সর্বত্র অপরাধের বিচার হবে।

”আজ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ও তার সদস্যরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কর্তব্য পালনের মাধ্যমে দ্বিতীয় স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। দেশকে গৌরবের শীর্ষে নিয়ে যাবেন এবং দেশবাসীকে উপভোগ করার সুযোগ করে দেবেন।”

সবাইকে নির্ভয়ে ও আনন্দের সঙ্গে কর্মস্থলে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ”দেশের সকল মানুষকে আজ স্বাধীন, নির্ভয়ে থাকার জন্য আমাদের ছাত্র শহীদরা প্রাণ দিয়েছে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার দেশের প্রত্যেকের সরকার। এখানে থাকবে সকলের আকাঙ্খা পূরণের অধিকার।

“অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যেই ছড়াবে, বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে। নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী সরকার দূর হয়ে গেছে।”

ছাত্র প্রতিনিধি থেকে উপদেষ্টা হওয়া নাহিদ ইসলাম বলেন, “গত রেজিমে যারা গুম, খুন, লুটপাটের সাথে জড়িত ছিল, তাদের বিচার করা এবং ইমেডিয়েটলি আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, জনমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জনদুর্ভোগ দূর করা, এই কাজগুলো এ সরকারের প্রথম কাজ হবে।

“এবং আমরা বলেছিলাম যে, রাষ্ট্র পূর্নগঠনের কাজটি করতে হবে। রাষ্ট্রের সংস্কার কাজটি করতে হবে। পুরো বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাতে হবে। যেমন সরকারে ভেতর ছাত্রদের নেতৃত্ব থাকবে, সকল কাজেও আমাদের উপস্থিতি থাকবে। সামগ্রিকভাবে আমরা একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে নিজেদের কাজে লাগাব।”

দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “অবশ্যই। এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ নিরর্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। কারণ বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ অনেকদিন ধরে তার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে এ সরকার কাজ করবে। কিন্তু তার আগে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার করা। নাহলে জনগণের অধিকার লংঘিত হবে।”

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আজকে তারা (তরুণরা) নিজেদের প্রাসঙ্গিক প্রমাণ করেছে। আমি আশা করব, নিশ্চয় তারাই দায়িত্ব একসময় না একসময় নেবে। এবং বলেই তো, আজকের তরুণ আগামী দিনের নেতা।”

আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “সকলের সম্মতিতে এমন একটি সরকার গঠন করতে পেরেছি বলে মনে করি। যেটি সারাদেশের জনগণ সাদরে গ্রহণ করবে।

“এ সরকারের যিনি প্রধান উপদেষ্টা তিনি হচ্ছেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেল লরিয়েট ব্যক্তি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেক্ষেত্রে এ সরকার বাংলাদেশে নতুন ধাঁচে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারব বলে প্রত্যাশা করি।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটা অভ্যুত্থান করেছে যেটি নতুন বাংলাদেশ রূপে আবির্ভূত করতে সহযোগিতা করতে পারবে। এই সরকারে যেমন নতুনত্ব রয়েছে, এ সরকার তেমনই নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারবে।

শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে দাবিগুলো রয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সচেষ্ট হবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।