মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫, বৈশাখ ৯ ১৪৩২, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬

ব্রেকিং

৪৪তম বিসিএসের ২২২ জন পরীক্ষার্থীর ভাইভা স্থগিত সাগর-রুনি হত্যা মামলার নথি পুড়েনি: ডিএমপি দ্বিতীয় ইনিংসে চাপে বাংলাদেশ একই ব্যক্তি টানা দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার পক্ষে বিএনপি সায়েন্স ল্যাবে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ তিন অঞ্চলে ৬০ কি. মি বেগে ঝড় হতে পারে এবারের বর্ষায়ও বন্যার কবলে পড়ার শঙ্কা ফেনীবাসীর ‘শখে’ জাল ফেলে উঠল ৩০ কেজির বাঘাইড়, বিক্রি ৩৫ হাজারে সাত দেশের ১৭ হাজার প্রবাসী ভোটারের আবেদন অনুমোদন রাজস্ব আদায়ে ৯ মাসে ঘাটতি ৬৫ হাজার কোটি টাকা এক মাস না যেতেই ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়ল আর্থনা সম্মেলনে যোগ দিতে দোহায় প্রধান উপদেষ্টা মেজর সিনহা হত্যা: ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে ‘অগ্রাধিকার’ স্ট্রোক এবং হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয় পোপের: ভ্যাটিকান রাজস্ব আদায়ে ৯ মাসে ঘাটতি ৬৫ হাজার কোটি টাকা দেশে স্বর্ণের দামে নতুন রেকর্ড শেখ হাসিনাসহ পরিবারের ১০ সদস্যের ‘এনআইডি লকড’ অর্থায়ন: ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলা আর্থিক সংকট ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে শহীদ নাজমুলের স্ত্রীর

শিশু

অনূদিত গল্প: হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্প- অন্যজন

 প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ২২ এপ্রিল ২০২৫

অনূদিত গল্প:  হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্প- অন্যজন

হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬)।

আর্জেন্টিনার কবি ও কথাসাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬)। তিনি জন্ম নেন বুয়েনস আইরেসে। বোর্হেস ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বড় হন, তবে তার সাহিত্যিক প্রতিভা শৈশব থেকেই স্পষ্ট ছিল। বোর্হেসের প্রথম কবিতার বই ‘ফেরভোর দে বুয়েনোস আইরেস’ ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়, তারপর তিনি কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি পান।

তার ছোটগল্প সংগ্রহগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ফিকশনেস’, ‘এল আলেফ’ ও ‘ল্যাবিরিন্থস’। ‘এল ওত্রো’ শিরোনামে এ গল্পটি বোর্হেসের ‘দ্য বুক অফ স্যান্ড’ সংকলনের প্রথম গল্প। মূল স্প্যানিশ থেকে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নরম্যান থোমাস দি জিওভানি। সেখান থেকেই এটি বাংলায় অনূদিত হলো। এ গল্পে বোর্হেস মুখোমুখি হন নিজের তরুণ ও বার্ধক্যপ্রাপ্ত সত্তার সাথে; যেন সময়ের ভাঁজে লুকোনো এক আত্মপরিচয়ের ধাঁধা।

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ক্যামব্রিজে, বোস্টনের উত্তরে। তখন আমি এ নিয়ে কিছু লিখিনি। কারণ আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিষয়টি ভুলে যাওয়া, যেন পাগল না হয়ে যাই। এখন, ১৯৭২ সালে এসে ভাবছি, যদি আমি এটি লিখে ফেলি, তাহলে মানুষ এটাকে গল্প হিসেবেই পড়বে। হয়তো একসময় আমিও এটাকে কেবল একটা গল্প হিসেবেই দেখব।

কিন্তু আমি জানি, ঘটনা আসলে কী, ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! তার পরের কয়েকটি নির্ঘুম রাত এটাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল। তবে, এটা পড়ে অন্য কেউ একইরকম অনুভব করবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। আমার জন্য তা এমনই এক সত্য, কেবল স্মৃতিতেই আটকে আছে। কিন্তু কল্পনা ও বাস্তবের বিভাজন এত সূক্ষ্ম, কখনও কখনও আমি নিজেও সন্দেহ করি— এটা কি সত্যিই ঘটেছে?

সকাল প্রায় দশটা হবে। আমি আরাম করে চার্লস নদীর ধারে একটা বেঞ্চে বসে আছি। আমার ডান দিকে প্রায় পাঁচশো গজ দূরে একটি উঁচু দালান, নাম জানি না। নদীর ধূসর স্রোতে বড় বড় বরফের টুকরো ভাসছে। নদী দেখে আমার মনে পড়ল হেরাক্লিটাসের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘একই নদীতে তুমি দুবার গোসল করতে পারবে না’। আগের রাতে ভালো ঘুমিয়েছি; সন্ধ্যায় যে ক্লাস নিয়েছি, তাতে ছাত্রদের আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে।

আশপাশে কোনো মানুষজন নেই। শীতের বাতাসে আমার গলার মাফলার কিছুটা শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম। হঠাৎ, আমার মনে হলো (মনোবিজ্ঞানীরা বলে, এটি ক্লান্তির লক্ষণ)— আমি এই মুহূর্তটি আগেও অনুভব করেছি। বেঞ্চের অপর প্রান্তে কেউ বসেছে। আমি একা থাকতে চাইছি, কিন্তু সাথে সাথে উঠে গেলে অশোভন দেখায়, তাই উঠলাম না। লোকটি শিস বাজাচ্ছে। আর তখনই আমার জন্য সেই সকালটি একাধিক চমকের প্রথমটি নিয়ে এলো।

লোকটি যে সুরটি বাজাচ্ছে বা বাজানোর চেষ্টা করছে (আমি কখনো সুর ঠিক রাখতে পারি না), তা আর্জেন্টাইন মিলোঙ্গা ‘লা তাপেরা’, এলিয়াস রেগুলেসের একটি জনপ্রিয় গান। সুরটি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই উঠোনে যা এখন আর নেই। ফিরিয়ে নিয়ে গেল আলভারো মেলিয়ান লাফিনুরের স্মৃতির কাছে, তিনিও বহু বছর আগে মারা গেছেন। তারপর এলো গানের কথাগুলো। কণ্ঠ আলভারোর নয়, কিন্তু লোকটি আলভারোর কণ্ঠ অনুকরণ করার চেষ্টা করছে। আমি আতঙ্কে তা চিনতে পারলাম।

আমি লোকটির দিকে ফিরলাম এবং কথা বললাম।

“আপনি উরুগুয়ের নাকি আর্জেন্টিনার?”

“আর্জেন্টিনার, তবে ১৯১৪ সাল থেকে জেনেভায় বাস করছি।”

দীর্ঘ নীরবতা। তারপর আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম।

“মালাগনৌ নম্বর সতেরোতে, রুশ পৌরাণিক গির্জার ঠিক বিপরীতে?”

সে মাথা নাড়ল।

“তাহলে,” আমি দৃঢ়ভাবে বললাম, “আপনার নাম হোর্হে লুইস বোর্হেস। আমিও হোর্হে লুইস বোর্হেস। আমরা এখন ১৯৬৯ সালে, ক্যামব্রিজ শহরে।”

“না,” সে আমারই কণ্ঠে, কিন্তু কিছুটা দূরত্বভরা স্বরে বলল, “আমি এখন জেনেভায়, একটি বেঞ্চে, রোন নদীর কয়েক ধাপ দূরে।”

তারপর একটু বিরতি নিয়ে সে বলল, “আমরা দেখতে এতটা একরকম, এটা সত্যিই আশ্চর্যের, তবে আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক, আপনার চুল ধূসর।”

“আমি আপনাকে প্রমাণ দিতে পারি যে আমি ঠিক কথাই বলছি,” আমি বললাম। “আমি আপনাকে এমন কিছু বলব যা একজন অপরিচিত জানার কথা নয়।”

আমাদের বাড়িতে একটি রূপার পাত্র আছে, তার তলায় সাপের নকশা রয়েছে। আমাদের প্রপিতামহ পেরু থেকে এনেছিলেন। এছাড়া সেখানে একটি রূপার বালতি আছে, ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো হতো। আপনার ঘরের আলমারিতে দুটি সারিতে রাখা বই রয়েছে: ‘আলিফ লায়লা’ বা ‘দ্য অ্যারাবিয়ান নাইটস’-এর তিন খণ্ড, কুইচেরাতের লাতিন অভিধান, ট্যাসিটাসের ‘জার্মানিয়া’, ইংরেজিতে গর্ডনের অনুবাদ, গার্নিয়ার সংস্করণের ‘দন কিহোতে’, রিভেরা ইনদারতের ‘তাবলাস দে সাঁগ্রে’ (লেখকের স্বাক্ষরসহ), কার্লাইলের ‘সার্টর রেসারটাস’, আমিয়েলের জীবনী, এবং লুকিয়ে রাখা একটি বই— বালকান অঞ্চলের যৌন রীতিনীতি নিয়ে লেখা। আর আপনি ভুলে যাননি সেই বিকেলের কথা, যা প্লাজা ডুফুরের দ্বিতীয় তলার অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়েছিলেন।”

“ডুবুর নয়, ডুফুর,” সে শুধরে দিল।

“ঠিক আছে, ডুফুর,” আমি বললাম। “এগুলো কি আপনার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ নয়?”

“না,” সে উত্তর দিল। “আপনার এসব কথায় কিছুই প্রমাণিত হয় না। যদি আমি আপনাকে স্বপ্ন দেখি, তবে স্বাভাবিকভাবেই আপনি আমার জানা সবকিছু জানবেন।”

আমি স্বীকার করলাম, তার আপত্তি ন্যায়সঙ্গত।

“যদি এই সকাল এবং এই সাক্ষাৎ স্বপ্ন হয়,” আমি উত্তর দিলাম, “তাহলে আমাদের দুজনেরই ভাবতে হবে যে আমরা একমাত্র স্বপ্নদ্রষ্টা। হয়তো আমাদের স্বপ্ন শেষ হবে, হয়তো হবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দায়িত্ব হলো স্বপ্নকে মেনে নেওয়া, যেমন আমরা বিশ্বকে মেনে নিয়েছি।”

“কিন্তু যদি এই স্বপ্ন দীর্ঘস্থায়ী হয়?” সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

তাকে শান্ত করতে এবং নিজেকেও শান্ত করার জন্য— আমি আত্মবিশ্বাসের ভান করলাম। “আমার স্বপ্ন ইতোমধ্যেই সত্তর বছর ধরে চলছে,” আমি বললাম। “তাছাড়া— যখন কেউ জেগে ওঠে, তখন সে নিজেকেই দেখতে পায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে, শুধু আমরা দুজন।”

আমাদের কথোপকথন দীর্ঘ হতে থাকল, আমরা সাহিত্যের কথা বললাম, অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করলাম। আমি জানতাম, এই তরুণ একদিন আমার মতোই হবে, যেমনটা আমি এখন।

হঠাৎ আমার মনে পড়ল কোলরিজের একটি কল্পকাহিনি— একজন মানুষ স্বপ্ন দেখে যে সে স্বর্গে রয়েছে, আর তাকে একটি ফুল দেওয়া হয় প্রমাণ হিসেবে। জেগে উঠার পর সে দেখে, ফুলটি সত্যিই তার হাতে রয়েছে। আমি তরুণ বোর্হেসকে একটি আমেরিকান নোট দিলাম, যাতে ১৯৬৪ সালের তারিখ লেখা ছিল। সে হতবাক হয়ে গেল, কারণ সেই তারিখ তার সময়ে অসম্ভব।

“এটি অলৌকিক ঘটনা,” সে ফিসফিস করে বলল। “এবং অলৌকিকতা ভয় জাগায়।” আমরা দুজনই জানতাম, পরের দিন আমরা আর বেঞ্চে ফিরে আসব না। এবং সত্যিই, আমরা আসিনি। আজ আমি বুঝতে পারি, ঘটনাটি বাস্তব ছিল, কিন্তু তরুণ বোর্হেস আমাকে স্বপ্ন দেখেছিল— এ কারণেই সে আমাকে ভুলে যেতে পেরেছে। আর আমি, যেহেতু জেগে ছিলাম, এখনও এই স্মৃতির ভার বহন করছি।